সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

যুক্তরাজ্যে সাবেক ক্ষমতাধরদের সম্পত্তি বেচাকেনা: হাসিনা সরকারের পতনের প্রভাব

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ২০, ২০২৫, ০৫:১২ পিএম

যুক্তরাজ্যে সাবেক ক্ষমতাধরদের সম্পত্তি বেচাকেনা: হাসিনা সরকারের পতনের প্রভাব

সংগৃহীত

আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সাবেক ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের বিলাসবহুল সম্পত্তি হস্তান্তর, বিক্রি ও পুনঃঋণায়নের (রিফাইন্যান্স) প্রবণতা চোখে পড়ার মতোভাবে বাড়ছে। ব্রিটিশ প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এবং আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর এক যৌথ অনুসন্ধানে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই যুক্তরাজ্যের বিলাসবহুল এলাকাগুলোর বাড়িঘর ও অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে অস্বাভাবিক রকমের বিক্রয় ও ফ্রিজিং কার্যক্রম শুরু হয়। এই তৎপরতা এতটাই বেড়েছে যে, তা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মে মাসে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (NCA) প্রায় ১ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা মূল্যের একটি অ্যাপার্টমেন্ট জব্দ করে। এই অ্যাপার্টমেন্টটির মালিকানা ছিল শেখ হাসিনার সাবেক বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান এবং ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের নামে। এর কিছুদিন পরই সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে থাকা প্রায় ২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার ৩০০টির বেশি সম্পত্তি জব্দ করা হয়, যা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নজরদারির বিষয়টি স্পষ্ট করে।

গভীর বিশ্লেষণ ও প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, শুধু গত এক বছরেই যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে অন্তত ২০টি উল্লেখযোগ্য সম্পত্তি লেনদেনের আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহানের নামে নাইটসব্রিজে চারতলা একটি বাড়ি ছিল, যেটি প্রথমে হস্তান্তর করা হয় এবং পরে এক গোপন হিসাবরক্ষকের মালিকানাধীন কোম্পানির কাছে ৭.৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি করা হয়। তার ভাই শাফিয়াত সোবহানও সারে’র ভার্জিনিয়া ওয়াটারে ৮ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি প্রাসাদোপম ম্যানসনের মালিকানা পরিবর্তন করেন। সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই আনিসুজ্জামান ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রিজেন্টস পার্কে অবস্থিত ১০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের টাউনহাউস বিক্রি করেন এবং আরও তিনটি সম্পত্তির জন্য 'রিফাইন্যান্স' আবেদন করেন। এদিকে, সালমান এফ রহমানের পরিবারের মালিকানাধীন লন্ডনের গ্রোসভেনর স্কয়ারে ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ইতোমধ্যে NCA কর্তৃক ফ্রিজ করা হয়েছে। তবে এই পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হচ্ছে এবং তারা যেকোনো তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

বিভিন্ন পক্ষের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আহসান মনসুর এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যতক্ষণ না তদন্ত শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ যেন এসব সম্পত্তি বিক্রি, স্থানান্তর বা বন্ধক রাখতে না দেওয়া হয়। গভর্নর মনসুর জোর দিয়ে বলেন, "আমরা নিশ্চিত, অনেকেই ইতোমধ্যে সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করছেন। তাই কঠোরভাবে এসব ফ্রিজ করা অত্যন্ত জরুরি।" ব্রিটেনের সংসদীয় দুর্নীতিবিষয়ক অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের প্রধান জো পাওয়েল সতর্ক করে বলেন, "ইতিহাস বলছে—যদি যথাসময়ে সম্পদ জব্দ করা না হয়, সেগুলো মুহূর্তেই গায়েব হয়ে যায়। লন্ডন যেন দুর্নীতিপরায়ণ ধনীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।" তদন্তে আরও প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, এই বিপুল সম্পত্তির লেনদেনে যুক্তরাজ্যের আইনজীবী ও পরামর্শদাতারা যথাযথ যাচাইবাছাই করেছেন কি না। তাদের ভূমিকা ও সতর্কতা নিয়ে ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্টরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

পরিশেষে বলা যায়, দ্য গার্ডিয়ান এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর এই যৌথ অনুসন্ধান কেবল বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্র উন্মোচন করছে না, বরং আন্তর্জাতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের নীতি ও দায়িত্ববোধকেও এক কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে। এই পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে মানি লন্ডারিং এবং অবৈধ সম্পদ পাচার রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা আরও একবার তুলে ধরেছে। যুক্তরাজ্যের পদক্ষেপ এই ধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধ দমনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, যা অন্যান্য দেশকেও অবৈধ সম্পদ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে উৎসাহিত করবে।