বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই, ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

গোপালগঞ্জে এনসিপি কর্মসূচি: দিনভর সংঘর্ষ ও সংঘাত

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ১৬, ২০২৫, ১১:৩৪ পিএম

গোপালগঞ্জে এনসিপি কর্মসূচি: দিনভর সংঘর্ষ ও সংঘাত

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘিরে দিনভর সহিংসতায় গোপালগঞ্জ শহরে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। দফায় দফায় সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলিতে গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চঘাট এলাকা রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করলেও, তা কার্যকর না হওয়ায় বুধবার রাত আটটা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

দিনাজপুর টিভির নিজস্ব প্রতিনিধি ঘটনাস্থল থেকে জানিয়েছেন, এবং তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছে যে, নিহত ব্যক্তিরা হলেন: গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা দীপ্ত সাহা (২৫), কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮), টুঙ্গীপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (২৪)। গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেষ বিশ্বাস বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন যে, বিকেলে তিনজনের মরদেহ হাসপাতালে আনা হয়, যারা গুলিবিদ্ধ ছিলেন। পরে আরও একজন নিহতের খবর পাওয়া যায়। নিহতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলেও জানান তিনি। এই ঘটনায় পুলিশসহ আরও অনেকে আহত হয়েছেন, যাদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।

সংঘর্ষের সূত্রপাত ও ঘটনাক্রম: 'দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা' কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার 'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' কর্মসূচি ঘোষণা করে এনসিপি। এই কর্মসূচিকে ঘিরে মঙ্গলবার রাত থেকেই জেলাটিতে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে গোপালগঞ্জের পৌরপার্ক এলাকায় আয়োজিত এনসিপি'র সমাবেশস্থলে প্রথম হামলা হয়। সে সময় এনসিপি'র কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশস্থলে পৌঁছাননি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক সাংবাদিক বিবিসি বাংলাকে জানান, হামলাকারীরা সভামঞ্চের সাউন্ড বক্স, মাইক, চেয়ার ভাঙচুরসহ উপস্থিত এনসিপি'র নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে এনসিপির নেতাকর্মীরা পাল্টা ধাওয়া দিয়ে সভাস্থলের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সমাবেশে বলেন, "মুজিববাদীরা আজকে বাধা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে আমরা বলেছিলাম, বাধা দিলে বাধবে লড়াই, সেই লড়াইয়ে জিততে হবে এবং সেই লড়াইয়ে আমরা জিতেছিলাম। আজকে আমাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। অচিরেই আমরা এর জবাব দেব ইনশাআল্লাহ।" তিনি আরও যোগ করেন, "আমরা নিশ্চিত করতে চাই, গোপালগঞ্জ নামের কারণে ভবিষ্যতের চাকরি ক্ষেত্রে বা অন্য কোনো স্থানে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না। কিন্তু গোপালগঞ্জে সন্ত্রাসীদের আস্তানা হতে আমরা দেবো না।"

সমাবেশ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে এনসিপি নেতাদের বহনকারী গাড়িবহর হামলার মুখে পড়ে। হামলাকারীরা ব্যাপক ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশ ও র‍্যাবের পাহারায় এনসিপির নেতাদের শহর থেকে বের করার চেষ্টা করা হলেও ব্যাপক হামলার মুখে তাদের আবারও শহরে ফিরিয়ে আনা হয়। কিছু সময় পর সেনাবাহিনীর একটি টহল টিম ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপরেও হামলা চালানো হয়। তখন সেনা সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছোড়েন বলে জানান ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা। একপর্যায়ে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহর ঘুরিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

অবরুদ্ধ এনসিপি নেতারা ও অভিযোগ: গাড়িবহরে হামলার ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ দলের শীর্ষ নেতারা। সেখানে এনসিপি নেতা নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, ''আমরা যখন রওনা দিয়েছি, তখন গ্রাম থেকে যত আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, সারা বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন এসে আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমরা এখন একটি জায়গায় অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছি।" হামলা প্রতিহতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন দলটির নেতারা। এনসিপি'র সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, মসজিদের মাইকগুলোতে ঘোষণা দিয়ে "সন্ত্রাসীদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান" জানানো হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ও সরকারের পদক্ষেপ: হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অনেকে আহত হন এবং অন্তত চারজন নিহত হন। নিহতদের নাম-পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি।

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রকিবুল হাসান বিবিসি বাংলাকে জানান, এনসিপি'র কর্মসূচিকে ঘিরে বুধবার সকালে তার এবং পুলিশের গাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার সকাল ১০টার দিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উপজেলার উলপুর গ্রামে পুলিশের একটি গাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেয় বলে গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মো. সাজেদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানান। ইউএনও’র গাড়িবহরেও কংসুর বাসস্ট্যান্ডে হামলা হয় এবং মি. হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, হামলাকারীরা ছিল "আওয়ামী লীগের লোকজন।" এসব ঘটনায় কর্মকর্তারা অক্ষত থাকলেও তাদের গাড়ি চালক "সামান্য আহত" হয়েছেন।

পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্র ব্যবহার করেনি বলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেছেন। তিনি আরও বলেন, "উচ্ছৃঙ্খলতা যা হয়েছে, সেটা যতটুকু সম্ভব আমরা ধৈর্যের সাথে প্রশমন করার চেষ্টা করছি, আমরা এখন রিইনফোর্সড (আরও পুলিশ সদস্য পাঠানো) করছি, পুরো জিনিসটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। আমরা লেথাল (প্রাণঘাতী) কোনো কিছু ব্যবহার করছি না। তাই আমাদের একটু সময় লাগছে।"

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও পরিস্থিতি: অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হামলাকারীদের "বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হবে না।" সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে এনসিপি আয়োজিত সমাবেশে বাধা দিয়ে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এনসিপি, পুলিশ এবং গণমাধ্যমের গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানিয়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।

এদিকে, হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেন, "দেশকে অস্থিতিশীল করতেই আওয়ামী লীগ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।" তিনি হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন এবং দেশে আবারও যাতে ফ্যাসিবাদের উত্থান না হয়, সেজন্য দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।

গোপালগঞ্জে রাত আটটা থেকে শুরু হয়েছে কারফিউ, যা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলবে। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্ধ্যার পরই গোপালগঞ্জ শহর অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। শহরজুড়ে র‍্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম খুলনায় সংবাদ সম্মেলন করে গোপালগঞ্জে হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ পালনের ঘোষণা দিয়েছেন এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার তদন্ত দাবি করেছেন।

পরবর্তী খবর
গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার সূচক ২০২৫

পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিশালী পাকিস্তান, সামগ্রিক শক্তিতে এগিয়ে ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

এপ্রিল ২৬, ২০২৫, ০৪:১৭ পিএম

Image

এআই দিয়ে তৈরি এইচএসসি পরীক্ষার মুহূর্ত।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক শক্তির তুলনা করা হলে সেখানে জনবল, অস্ত্রশস্ত্র, বাজেট, পারমাণবিক ক্ষমতা ও কৌশলগত নীতি–আদর্শের এক জটিল হিসাব–নিকাশ প্রতিফলিত হয়। ১৯৪৭ সালে বিভক্তির পর থেকে দুই দেশ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছে। এ সময়ে একাধিক যুদ্ধে জড়ানোর ইতিহাস রয়েছে তাদের। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে উভয় দেশ উল্লেখ করার মতো সামরিক শক্তিও বজায় রেখে চলেছে।

গত মঙ্গলবার ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ওই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। এ হামলায় পাকিস্তানের মদদ থাকার অভিযোগ তুলে ভারত দেশটির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। পাল্টা ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে পাকিস্তানও।

এমন প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তান সামরিকভাবেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে—এ আশঙ্কা অনেকের। প্রাসঙ্গিকভাবে উভয় দেশের সামরিক সক্ষমতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসছে। এই সক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিয়ে বিশ্লেষণমূলক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়াভিত্তিক ‘ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া’।

‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার সূচক (জিএফপি) ২০২৫’ অনুসারে করা এ প্রতিবেদন ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়ার ওয়েবসাইটে গতকাল শুক্রবার প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:

সামগ্রিক সামরিক র‍্যাঙ্কিং ও সক্ষমতা সূচক

‘জিএফপি ২০২৫’–এ ৬০টির বেশি বিষয়ের (জনশক্তি, সামরিক সরঞ্জাম, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থা ইত্যাদি) ভিত্তিতে ১৪৫টি দেশকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, সামগ্রিক র‍্যাঙ্কিংয়ে ভারত বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ, সক্ষমতা সূচকে স্কোর ০.১১৮৪ (কম স্কোর মানে বেশি শক্তিশালী সেনাবাহিনী)। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান বিশ্বে ১২তম, স্কোর ০.২৫১৩।

র‍্যাঙ্কিংয়ে ভারতের এ অবস্থান দেশটির বড় জনসংখ্যা, বৃহত্তর প্রতিরক্ষা বাজেট ও বিস্তৃত পরিসরের সামরিক সম্পদের প্রতিফলন। অন্যদিকে পাকিস্তান ছোট অর্থনীতির কারণে নানা সীমাবদ্ধতা ও বৈদেশিক সরবরাহকারী, বিশেষ করে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা সত্ত্বেও ভারতকে মোকাবিলায় কৌশলগত বিষয়গুলোয় মনোযোগী। ফলে নির্দিষ্ট খাতগুলোয় প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে দেশটি।

র‍্যাঙ্কিংয়ে ভারতের এ অবস্থান দেশটির বড় জনসংখ্যা, বৃহত্তর প্রতিরক্ষা বাজেট ও বিস্তৃত পরিসরের সামরিক সম্পদের প্রতিফলন। অন্যদিকে পাকিস্তান ছোট অর্থনীতির কারণে নানা সীমাবদ্ধতা ও বৈদেশিক সরবরাহকারী, বিশেষ করে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা সত্ত্বেও ভারতকে মোকাবিলায় কৌশলগত বিষয়গুলোয় মনোযোগী। ফলে নির্দিষ্ট খাতগুলোয় প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে দেশটি।

সামরিক–বেসামরিক জনশক্তি
প্রচলিত যুদ্ধে জনবল গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। ভারত ও পাকিস্তানের জন্যও তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশাল জনসংখ্যা ও স্থলবাহিনীর ওপর উভয় দেশেরই নির্ভরতা রয়েছে।

ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি (বিশ্বে দ্বিতীয়)। সক্রিয় জনশক্তি ৬৬ কোটি ২০ লাখ। সক্রিয় সেনা ১৪ লাখ ৬০ হাজার (বিশ্বে দ্বিতীয়)। রিজার্ভ সেনা ১১ লাখ ৬০ হাজার (বিশ্বে সপ্তম)। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লাখ ৩০ হাজার (বিশ্বে দ্বিতীয়)। মোট সামরিক (সক্রিয় ও রিজার্ভ সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনী) জনবল ৫১ লাখ।

অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৫ কোটি ২০ লাখ (বিশ্বে পঞ্চম)। সক্রিয় জনবল ১০ কোটি ৮০ লাখ। সক্রিয় সেনা ৬ লাখ ৫৪ হাজার (বিশ্বে সপ্তম)। রিজার্ভ সেনা ৬ লাখ ৫০ হাজার। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য জিএফপিতে স্পষ্টভাবে পরিমাপ করা হয়নি, তবে উল্লেখযোগ্য (রেঞ্জার্স ও ফ্রন্টিয়ার কোরসহ)। মোট সামরিক শক্তি ১৭ লাখ (সক্রিয়, রিজার্ভ ও আধা সামরিক বাহিনী)।

ভারতের জনবল পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি এবং রিজার্ভ ও আধা সামরিক বাহিনীও বড়। পাকিস্তান যদিও কম জনবল নিয়ে কাজ করে, তবে তাদের মধ্যে ‘মুজাহিদ’–এর মতো আইএসআই–নিয়ন্ত্রিত অনিয়মিত বাহিনীগুলো রয়েছে।

প্রতিরক্ষা বাজেট

ভারতের বাজেট (২০২৫-২৬) ৭ হাজার ৯০০ কোটি ডলার (যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর তৃতীয়)। এটি জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ। এ ব্যয় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।

পাকিস্তানের বাজেট ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার (অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শীর্ষ দেশের তালিকায় নেই)। এ ব্যয় জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বৈদেশিক সামরিক সহায়তা ১০ কোটি ডলার (মূলত চীন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে)।

ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের ৬ থেকে ৮ গুণ। এ বিপুল প্রতিরক্ষা ব্যয় ভারতের সামরিক খাতে প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত এবং জনশক্তির আধুনিকীকরণে আরও বেশি বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হচ্ছে। পাকিস্তান বাজেট–সংকটে ভুগলেও চীনের সহায়তা এটিকে সামাল দিচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক ব্যয়ের বড় অংশ ব্যয় হয় বৃহৎ সেনাবাহিনী ও পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষায়।

স্থলবাহিনী

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্থলবাহিনী। দেশ দুটির মধ্যে ৩ হাজার ৩২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত। দুদেশের মধ্যে ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৯৯ সালে প্রচলিত ঘরানার যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে।

ভারতের ট্যাংক ৪ হাজার ৬১৪টি। সাঁজোয়া যান ১ লাখ ৫১ হাজার ২৪৮টি। কামান ৯ হাজার ৭১৯টি। বিশেষ বাহিনীর মধ্যে আছে প্যারা এসএফ, ঘাতক ফোর্স, এমএআরসিওএস।

পাকিস্তানের ট্যাংক ৩ হাজার ৭৪২টি। সাঁজোয়া যান ৫০ হাজার (আনুমানিক)। কামান ৪ হাজার ৪৭২টি (৩৭৫ স্বয়ংক্রিয় হাউইটজারসহ)। বিশেষ বাহিনীর মধ্যে আছে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি), এসএসজি নৌ ও স্পেশাল সার্ভিস উইং। এগুলো আকারে তুলনামূলক ছোট হলেও সমীহ করার মতো।

ট্যাংক, সশস্ত্র যান ও কামানে সংখ্যাগত দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ভারত। পাকিস্তানেরও ট্যাংকবহর প্রতিযোগিতামূলক। এ বহর চীনের ভিটি–৪–এর মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা। রয়েছে এম১১৩ ও আল–ফাহাদের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা স্থল সমরযান।

বিমানবাহিনী

আধুনিক যুদ্ধে, বিশেষত দ্রুত সাড়া দেওয়া ও নির্ভুল আক্রমণের জন্য বিমান বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের মোট বিমান ২ হাজার ২২৯টি। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান ৫১৩ থেকে ৬০৬টি। আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এসইউ–৩০এমকেআই, রাফায়েল, তেজস। রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস–৪০০। হেলিকপ্টার আছে অ্যাপাচি ও চিনুক। আরও আছে চারটি ‘এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল (এইডব্লিউঅ্যান্ডসি)’ ব্যবস্থা।

পাকিস্তানের মোট বিমান ১ হাজার ৩৯৯ থেকে ১ হাজার ৪৩৪টি। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান ৩২৮ থেকে ৩৮৭টি। আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এফ–১৬ ফাইটিং ফ্যালকন, জেএফ–১৭ থান্ডার, মিরেজ থ্রি/ফাইভ। আছে ভারতের চেয়ে বেশি যুদ্ধে ব্যবহার উপযোগী হেলিকপ্টার (এএইচ–১এফ কোবরাসহ)। এইডব্লিউঅ্যান্ডসি আছে সাতটি, যা ভারতের চেয়ে বেশি।

ভারতের বিমানবহর আকারে বড় ও বৈচিত্র্যময়; তবে স্কোয়াড্রনের ঘাটতি আছে। পাকিস্তানের বিমানবহর তুলনামূলক ছোট হলেও তার আধুনিকায়ন হচ্ছে। পাকিস্তানের এইডব্লিউঅ্যান্ডসি–সুবিধা বাড়তি নজরদারিতে ব্যবহার করা হয়।

নৌবাহিনী

ভারত মহাসাগরে ভারতের সামুদ্রিক স্বার্থ রক্ষায় ও আরব সাগরে পাকিস্তানের অভিযানের জন্য নৌসক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের জাহাজ রয়েছে ২৯৪টি। বিমানবাহী রণতরি আছে ২টি। সাবমেরিন ১৮টি (পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন আইএনএস আরিহান্টসহ)। ডেস্ট্রয়ার ১৩টি। ফ্রিগেট ১৪টি। প্যাট্রোল নৌযান ১০৬টি। যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী বিমান ৭৫টি (নৌবাহিনীর)। নৌবাহিনী সদস্যসংখ্যা ৬৭ হাজার ৭০০।

পাকিস্তানের জাহাজ ১২১টি। সাবমেরিন ৮টি। ফ্রিগেট ৯টি। প্যাট্রোল নৌযান ১৭টি। এ বাহিনীর যুদ্ধবিমান ৮টি। নৌবাহিনী সদস্যসংখ্যা ২৩ হাজার ৮০০।

ভারতীয় নৌবাহিনী তুলনামূলক বেশি শক্তিশালী ও গভীর সমুদ্রে অভিযান চালানোর উপযোগী। পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত ছোট নৌবাহিনী মূলত উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ও আঞ্চলিক অভিযানে মনোযোগ দেয়। বিমানবাহী রণতরি না থাকা ও সীমিতসংখ্যক যুদ্ধবিমানের কারণে গভীর সমুদ্র দেশটির নৌবাহিনীর অভিযান চালানোয় সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

পারমাণবিক সক্ষমতা

ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী। তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলে এ সক্ষমতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০টি। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে অগ্নি–থ্রি/ফাইভ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (পাল্লা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কিলোমিটার), মিরেজ ২ হাজার ও রাফায়েল এবং সামুদ্রিক প্রতিরক্ষায় আইএনএস আরিহান্ট। পারমাণবিক অস্ত্র আগে ব্যবহার না করার (নো ফার্স্ট ইউজ/এনএফইউ) নীতির পক্ষে ভারত। তবে এ ধরনের হামলার শিকার হলে ব্যাপক আকারে প্রতিশোধমূলক হামলার পক্ষে দেশটি।

অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৪০ থেকে ১৫০। এদিক থেকে পাকিস্তানের সক্ষমতা ভারতের চেয়ে বেশি। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে আছে শাহিন–টু/থ্রি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাত্র, এফ–১৬ যুদ্ধবিমান, বাবর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশটি ‘ফুল–স্পেকট্রাম ডেটারেন্স’ নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী। এ নীতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে দেশটি প্রয়োজনে আগেভাগে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।

কৌশলগত জোট ও জটিল মূল্যায়ন

ভারতের কৌশলগত জোটে রয়েছে ইসরায়েল, রাশিয়া ও ফ্রান্স। অন্যদিকে পাকিস্তানের রয়েছে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। আছে সীমিত পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও।

জনবল, সামরিক ব্যয় ও প্রচলিত অন্যান্য প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের এগিয়ে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হলেও পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পরমাণু ও কৌশলগত অস্ত্রের সমৃদ্ধ ভান্ডার, অপ্রতিসম যুদ্ধকৌশল ও চীনের জোরালো সমর্থন দেশটিকে এক সুবিধাজনক প্রতিরক্ষা অবস্থানে রেখেছে।

প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের আধুনিকায়নে অন্যতম বাধা তার আমলাতন্ত্র ও দ্বৈত মনোযোগ (চীন–পাকিস্তান)। পুরোনো বিমানবহরও দেশটির জন্য একটি বাধা। ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অভিযানে বেশি মনোযোগও দেশটির আরেক দুর্বলতা।

অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংগ্রাম, তুলনামূলক ছোট জনশক্তি, পুরোনো সামরিক সরঞ্জাম ও আঞ্চলিক উত্তেজনা তার সামরিক সক্ষমতায় বাধা হয়ে আছে।

আরএস