জুলাই ১৬, ২০২৫, ১১:৩৪ পিএম
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘিরে দিনভর সহিংসতায় গোপালগঞ্জ শহরে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। দফায় দফায় সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলিতে গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চঘাট এলাকা রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করলেও, তা কার্যকর না হওয়ায় বুধবার রাত আটটা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
দিনাজপুর টিভির নিজস্ব প্রতিনিধি ঘটনাস্থল থেকে জানিয়েছেন, এবং তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছে যে, নিহত ব্যক্তিরা হলেন: গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা দীপ্ত সাহা (২৫), কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮), টুঙ্গীপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (২৪)। গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেষ বিশ্বাস বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন যে, বিকেলে তিনজনের মরদেহ হাসপাতালে আনা হয়, যারা গুলিবিদ্ধ ছিলেন। পরে আরও একজন নিহতের খবর পাওয়া যায়। নিহতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলেও জানান তিনি। এই ঘটনায় পুলিশসহ আরও অনেকে আহত হয়েছেন, যাদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।
সংঘর্ষের সূত্রপাত ও ঘটনাক্রম: 'দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা' কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার 'মার্চ টু গোপালগঞ্জ' কর্মসূচি ঘোষণা করে এনসিপি। এই কর্মসূচিকে ঘিরে মঙ্গলবার রাত থেকেই জেলাটিতে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে গোপালগঞ্জের পৌরপার্ক এলাকায় আয়োজিত এনসিপি'র সমাবেশস্থলে প্রথম হামলা হয়। সে সময় এনসিপি'র কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশস্থলে পৌঁছাননি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক সাংবাদিক বিবিসি বাংলাকে জানান, হামলাকারীরা সভামঞ্চের সাউন্ড বক্স, মাইক, চেয়ার ভাঙচুরসহ উপস্থিত এনসিপি'র নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে এনসিপির নেতাকর্মীরা পাল্টা ধাওয়া দিয়ে সভাস্থলের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সমাবেশে বলেন, "মুজিববাদীরা আজকে বাধা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে আমরা বলেছিলাম, বাধা দিলে বাধবে লড়াই, সেই লড়াইয়ে জিততে হবে এবং সেই লড়াইয়ে আমরা জিতেছিলাম। আজকে আমাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। অচিরেই আমরা এর জবাব দেব ইনশাআল্লাহ।" তিনি আরও যোগ করেন, "আমরা নিশ্চিত করতে চাই, গোপালগঞ্জ নামের কারণে ভবিষ্যতের চাকরি ক্ষেত্রে বা অন্য কোনো স্থানে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না। কিন্তু গোপালগঞ্জে সন্ত্রাসীদের আস্তানা হতে আমরা দেবো না।"
সমাবেশ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে এনসিপি নেতাদের বহনকারী গাড়িবহর হামলার মুখে পড়ে। হামলাকারীরা ব্যাপক ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশ ও র্যাবের পাহারায় এনসিপির নেতাদের শহর থেকে বের করার চেষ্টা করা হলেও ব্যাপক হামলার মুখে তাদের আবারও শহরে ফিরিয়ে আনা হয়। কিছু সময় পর সেনাবাহিনীর একটি টহল টিম ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপরেও হামলা চালানো হয়। তখন সেনা সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছোড়েন বলে জানান ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা। একপর্যায়ে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহর ঘুরিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
অবরুদ্ধ এনসিপি নেতারা ও অভিযোগ: গাড়িবহরে হামলার ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ দলের শীর্ষ নেতারা। সেখানে এনসিপি নেতা নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, ''আমরা যখন রওনা দিয়েছি, তখন গ্রাম থেকে যত আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, সারা বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন এসে আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমরা এখন একটি জায়গায় অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছি।" হামলা প্রতিহতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন দলটির নেতারা। এনসিপি'র সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, মসজিদের মাইকগুলোতে ঘোষণা দিয়ে "সন্ত্রাসীদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান" জানানো হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ও সরকারের পদক্ষেপ: হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অনেকে আহত হন এবং অন্তত চারজন নিহত হন। নিহতদের নাম-পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রকিবুল হাসান বিবিসি বাংলাকে জানান, এনসিপি'র কর্মসূচিকে ঘিরে বুধবার সকালে তার এবং পুলিশের গাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার সকাল ১০টার দিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উপজেলার উলপুর গ্রামে পুলিশের একটি গাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেয় বলে গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মো. সাজেদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানান। ইউএনও’র গাড়িবহরেও কংসুর বাসস্ট্যান্ডে হামলা হয় এবং মি. হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, হামলাকারীরা ছিল "আওয়ামী লীগের লোকজন।" এসব ঘটনায় কর্মকর্তারা অক্ষত থাকলেও তাদের গাড়ি চালক "সামান্য আহত" হয়েছেন।
পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্র ব্যবহার করেনি বলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেছেন। তিনি আরও বলেন, "উচ্ছৃঙ্খলতা যা হয়েছে, সেটা যতটুকু সম্ভব আমরা ধৈর্যের সাথে প্রশমন করার চেষ্টা করছি, আমরা এখন রিইনফোর্সড (আরও পুলিশ সদস্য পাঠানো) করছি, পুরো জিনিসটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। আমরা লেথাল (প্রাণঘাতী) কোনো কিছু ব্যবহার করছি না। তাই আমাদের একটু সময় লাগছে।"
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও পরিস্থিতি: অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হামলাকারীদের "বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হবে না।" সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে এনসিপি আয়োজিত সমাবেশে বাধা দিয়ে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এনসিপি, পুলিশ এবং গণমাধ্যমের গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানিয়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।
এদিকে, হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেন, "দেশকে অস্থিতিশীল করতেই আওয়ামী লীগ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।" তিনি হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন এবং দেশে আবারও যাতে ফ্যাসিবাদের উত্থান না হয়, সেজন্য দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
গোপালগঞ্জে রাত আটটা থেকে শুরু হয়েছে কারফিউ, যা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলবে। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্ধ্যার পরই গোপালগঞ্জ শহর অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। শহরজুড়ে র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম খুলনায় সংবাদ সম্মেলন করে গোপালগঞ্জে হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ পালনের ঘোষণা দিয়েছেন এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার তদন্ত দাবি করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন: