জুলাই ১৭, ২০২৫, ০৫:৩৭ পিএম
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উর্বর জনপদ ঝিনাইদহের বিভিন্ন এলাকায় এখন পরীক্ষামূলকভাবে নয়, বরং বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো ও আঙুরের মতো ভিনদেশী ফল। দেশের বাজারের চাহিদা পূরণে এতদিন এসব মূল্যবান ফল বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও, এখন পলিমাটির বাংলাদেশেও এর সফল আবাদ দেখা যাচ্ছে, যা কৃষি খাতে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পর এসব ফল বিক্রি হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য শহরে।
জানা গেছে, জেলার কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, হরিণাকুণ্ডু ও সদর উপজেলায় এবছর আঙুরের চাষ হয়েছে চোখে পড়ার মতো। শখের বশে আঙুর চাষ শুরু করলেও ভালো ফলন পাওয়ায় কৃষকরা এখন বাণিজ্যিক আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। পতিত জমিতেও আঙুর, অ্যাভোকাডোর বাম্পার ফলন পেয়েছেন চাষীরা। কৃষকরা জানিয়েছেন, পরীক্ষামূলক এসব বিদেশি ফলের আবাদ করে দারুণ ফলন পাওয়ায় বিদেশি ফল চাষে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার চাচড়া গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা শাহিনুর রহমান তিন বিঘা জমিতে বিদেশি ফল অ্যাভোকাডো লাগিয়েছেন। ২০১৯ সালে থাইল্যান্ড থেকে চারা এনে রোপণের প্রায় পাঁচ বছর পর তিনি দারুণ ফলন পেয়েছেন। তার লাগানো গাছে গাছে এখন প্রচুর অ্যাভোকাডো ঝুলছে। শাহিনুর রহমান জানান, স্থানীয় বাজারে অ্যাভোকাডোর চাহিদা কম থাকলেও ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরের রেস্তোরাঁগুলোতে এর চাহিদা ব্যাপক। স্থানীয় বাজারে কেজি প্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে অ্যাভোকাডো বিক্রি হলেও, ঢাকা-চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে এটি গড়ে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়।
কালীগঞ্জ উপজেলার আরেক কৃষি উদ্যোক্তা ও স্কুলশিক্ষক হাফিজুর রহমান লংগান চাষ করে দারুণ সাফল্য পেয়েছেন। তিনি জানান, লংগান বিদেশি ফল হলেও এর চাষে তেমন কোনো খরচ নেই, শুধু পরিচর্যা করলেই হয় এবং রাসায়নিক বা কীটনাশকের ব্যবহারও বেশি করা লাগে না। আগামীতে তিনি রাম্বুটানসহ অন্যান্য কয়েকটি বিদেশি ফল চাষের পরিকল্পনা নিয়েছেন।
এদিকে, জেলার মহেশপুর, হরিণাকুণ্ডু ও সদর উপজেলায় আঙুর চাষ বেড়েছে। সবুজ আঙুরের পাশাপাশি এসব উপজেলায় রঙিন আঙুরের চাষ হচ্ছে। সদর উপজেলার বেতাই গ্রামের আঙুর চাষী আরিফুল ইসলাম পরীক্ষামূলকভাবে আঙুর চাষে সফলতা পেয়েছেন এবং আগামী বছর আবাদ বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছেন। মহেশপুর উপজেলার আব্দুর রশিদ জানান, তিনি এবছর তিন বিঘা জমিতে আঙুর চাষ করেছিলেন এবং বিদেশি আঙুরের অন্তত ১২টি জাতের চারা রোপণ করে বাগান গড়েছেন। জাতের ভিন্নতা থাকায় তার বাগানে খয়েরি, লাল ও সবুজ আঙুরের ভালো ফলন হয়েছে এবং দামও ভালো পাওয়া গেছে। তিনি আঙুর চাষের পাশাপাশি মানসম্মত চারা উৎপাদনেরও লক্ষ্য রেখেছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ মৌসুমে জেলায় ১ হেক্টর জমিতে রাম্বুটান আবাদ হয়েছে, যার পরীক্ষামূলক চাষ কালীগঞ্জ ও কোটচাঁদপুর উপজেলায় করেছেন কৃষকরা। এছাড়া, জেলায় ২ হেক্টর জমিতে অ্যাভোকাডো চাষ হয়েছে, যার মধ্যে কালীগঞ্জে ১.৭৫ হেক্টর, কোটচাঁদপুরে ১ হেক্টর ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় ০.২৪ হেক্টর জমিতে কৃষকরা অ্যাভোকাডো আবাদ করেছেন। জেলার সদর উপজেলা, হরিণাকুণ্ডু, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলায় ২.২৫ হেক্টর জমিতে আঙুরের পরীক্ষামূলক চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ০.৪৪ হেক্টর, কালীগঞ্জে ০.৫৫ হেক্টর, কোটচাঁদপুরে ০.৩১ হেক্টর, মহেশপুরে ০.৬৬ হেক্টর ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় ০.২৯ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের বিদেশি আঙুরের আবাদ করেছেন চাষীরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ষষ্ঠী চন্দ্র রায় জানান, জেলার প্রতিটি উপজেলার মাটির একটি বিশেষ গুণ আছে, যার কারণে এই মাটিতে নানান রকম বিদেশি ফলের আবাদ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। তিনি বলেন, “পরীক্ষামূলকভাবে কৃষকেরা চাষাবাদ শুরু করলেও সফলতা আসার পরে তা বাণিজ্যিক আবাদে রূপান্তরিত হচ্ছে। এটা আমাদের কৃষিতে এক দারুণ বিপ্লব বলা যায়। বিদেশি ফলের আবাদ বাড়লে ফলের আমদানি নির্ভরতা কমবে। বাঁচবে কৃষক, সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।”
আপনার মতামত লিখুন: