জুলাই ১৭, ২০২৫, ০৪:২৫ পিএম
লালমনিরহাট জেলার কৃষি অর্থনীতিতে কলা চাষ এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বিশেষ করে জেলার বুদারুর চর ও তিস্তা নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলসহ অন্যান্য চর এলাকায় কৃষকরা এখন ধান, পাট, আলু ও ভুট্টার মতো প্রচলিত ফসলের পরিবর্তে কলা চাষে ঝুঁকছেন। কৃষকদের মতে, কলা চাষে কম খরচ, কম পরিশ্রম এবং অধিক লাভের নিশ্চয়তা রয়েছে, যা তাদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে এবং একটি সুসংগঠিত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
ঘটনার প্রেক্ষাপট:
লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী হাট ধীরে ধীরে কলার কেন্দ্রীয় বাজারে পরিণত হয়েছে। সপ্তাহের শনিবার ও বুধবার এই দুই দিন হাটে ভোর থেকেই কলার জমজমাট কেনা-বেচা শুরু হয় এবং কখনো কখনো ভোর হওয়ার আগেই বিক্রি শেষ হয়ে যায়। হাট ইজারাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড়বাড়ী হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার কলা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। শুধু লালমনিরহাট নয়, পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রামের রাজারহাট, রংপুরের কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়ার চাষিরাও এই হাটে কলা আনেন। রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এখানকার কলা সরবরাহ করা হয়।
চাষিরা জানান, বর্তমানে চরাঞ্চলে উন্নত জাতের মালভোগ, চিনি চম্পা, মেহের, সাগর ও রঙিন কলার চাষ হচ্ছে। চিনি চম্পা জাতটি রোগ প্রতিরোধক্ষম ও ফলন বেশি হওয়ায় চাষিদের মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তবে মালভোগ কলার বাজারমূল্য বেশি হলেও রোগপ্রবণ হওয়ায় তা তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের চাষি আলতাব আলী জানান, তিনি ১০ বছর ধরে কলা চাষ করছেন। প্রতি বিঘা কলা চাষে ২৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয় এবং বছরে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। কলা চাষি সাইদুল মিয়া মাত্র ১৭ শতক জমিতে কলা চাষ করে এবার ৪০ হাজার টাকার কলা বিক্রি করেছেন এবং চিনি চম্পা জাতের কলা চাষে ভালো লাভের আশা করছেন।
বড়বাড়ী হাটের কলা ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান জানান, চাষিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো এবং প্রতি হাটে প্রায় ৫০০-৬০০ কাঁদি কলা ট্রাকে করে ঢাকায় পাঠান। তবে পরিবহন খরচ ও শ্রমিক মজুরি বেড়ে যাওয়ায় লাভ কিছুটা কমেছে। স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ জানান, বড়বাড়ী হাটে প্রায় ২৫-৩০ জন বড় আড়তদার আছেন যারা ট্রাকে করে প্রতি হাটে লাখ লাখ টাকার কলা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠান। তিনি আরও বলেন, বড় ট্রাকে একবারে ৭০০ কাঁদি এবং ছোট ট্রাকে প্রায় ৪৫০ কাঁদি কলা পরিবহন করা সম্ভব। এই হাটে প্রায় শতাধিক শ্রমিক লোড-আনলোডের কাজে যুক্ত থাকেন, যা শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ৯.৫ থেকে ১০ লাখ টন কলা উৎপাদিত হয়, যা দেশীয় ফলের মধ্যে আমের পরেই দ্বিতীয় সর্বাধিক উৎপাদিত ফল। কলা চাষের জন্য লালমনিরহাটের চরাঞ্চলগুলো বিশেষভাবে উপযোগী। বেলে দোআঁশ মাটি ও সহজ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা কলা চাষে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. সাইখুল আরিফিন বলেন, কলা একটি বর্ষজীবী ফসল। একবার রোপণ করলে কয়েক বছর ফলন পাওয়া যায়। চরাঞ্চলের জমিতে কলা চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে। কৃষি বিভাগ নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে কৃষকদের সহায়তা করছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, লালমনিরহাটের কলা এখন আর শুধুই বিকল্প ফসল নয়, বরং এটি কৃষির টেকসই সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। চাষিদের নিষ্ঠা, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এই সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
আপনার মতামত লিখুন: