জুলাই ১৮, ২০২৫, ১১:১৪ এএম
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে কাঁকড়া চাষ বেকারত্ব নিরসন এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক বিশাল সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আর্থোপোড শ্রেণির শক্ত খোলসবিশিষ্ট এই জলজ প্রাণীটি যদিও স্থানীয়ভাবে খাদ্য হিসেবে তেমন জনপ্রিয় নয়, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
কাঁকড়া বা ম্যাডক্রাব, যার বৈজ্ঞানিক নাম সাইলা সিরেটা, মূলত আফ্রিকার পূর্ব উপকূলীয় ভারত উপকূল এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ এলাকায় দেখা যায়। বাংলাদেশে মিঠা পানিতে চার প্রজাতির এবং লোনা পানিতে এগারো প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। তবে, রপ্তানি হয় কেবলমাত্র সামুদ্রিক বড় আকারের শিলা কাঁকড়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসহ ইউরোপ মহাদেশেও এই শিলা কাঁকড়ার মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৪ কোটি টাকার কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। বিশ্ব বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এর সংগ্রহ প্রক্রিয়া যেমন বেড়েছে, তেমনি কাঁকড়া চাষপদ্ধতির কলাকৌশল সম্পর্কেও চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে কাঁকড়া চাষ প্রক্রিয়া এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমান রপ্তানিকৃত কাঁকড়ার প্রায় সবটাই উপকূলীয় চিংড়ি খামার, সমুদ্রের মোহনা, নদী এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক বা প্রজননক্ষম কাঁকড়ার ওজন সাধারণত ৩০০-৫০০ গ্রাম হয়, যদিও সর্বোচ্চ ৫ কেজি ওজনের কাঁকড়াও পাওয়া গেছে। একটি স্ত্রী কাঁকড়া ১-৮ মিলিয়ন ডিম দিতে পারে। কাঁকড়া দৈহিক বৃদ্ধির জন্য খোলস পরিবর্তন করে এবং এটি মাটিতে ও বাঁধে গর্ত করতে পছন্দ করে, যা ম্যানগ্রোভ এলাকায় এদের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে।
কাঁকড়া চাষের সুবিধা ও উপযুক্ত পরিবেশ:
বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে কাঁকড়া চাষের উপযুক্ত পরিবেশ বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা থাকায় এই উৎপাদন লাভজনক। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পোনা (কিশোর) পাওয়া যায় এবং কাঁকড়ার খাবার স্বল্পমূল্যে সংগ্রহ করা সম্ভব। ওজন হিসেবে কাঁকড়ার বৃদ্ধির হার বেশি এবং এটি পঁচা আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ রক্ষা করে।
কাঁকড়া চাষের জন্য বাগদা চিংড়ি চাষের ন্যায় উপকূলের লবণাক্ত পানি উপযুক্ত। মাটির গুণাবলির মধ্যে নরম দোঁআশ বা এঁটেল মাটি, হাইড্রোজেন সালফাইট ও অ্যামুনিয়া গ্যাসযুক্ত মাটি, ৭-১২% জৈব পদার্থ এবং অ্যাসিড সালফেটমুক্ত পরিবেশ বাঞ্ছনীয়। পানির ক্ষেত্রে ১০-২৫ পিপিটি লবণাক্ততা, ২৫-৩০ সে. তাপমাত্রা, ৭.৫-৮.৫ পিএইচ, ৮০ মি.গ্রা/লি. অ্যালকালিনিটি, ৪০-১০০ পিপিএম হার্ডনেস এবং ৪ পিপিএমের ঊর্ধ্বে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা উচিত।
কাঁকড়া চাষের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাগদা চিংড়ি চাষের উপযুক্ত স্থানই অগ্রাধিকার পায়। কাঁকড়ার পুকুরে প্রতিনিয়ত লবণাক্ত পানি পরিবর্তনের সুযোগ থাকতে হবে এবং এটি বন্যপ্রাণী ও পাখিমুক্ত হতে হবে। পুকুরের আয়তন ০.২-১.০ হেক্টর হলে ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয় এবং গভীরতা ১.০-১.৫ মিটার রাখা ভালো। পুকুর নির্মাণের সময় মজবুত বাঁধ এবং কাঁকড়া পালিয়ে যাওয়া রোধ করতে ০.৫ মিটার উঁচু বেড়া স্থাপন করা আবশ্যক।
চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা:
পুকুর প্রস্তুতির জন্য মাটি শুকানো ও ধৌতকরণ, চুন প্রয়োগ, এবং কাঁকড়ার আশ্রয়স্থল সৃষ্টির উপর জোর দেওয়া হয়। ডিম্বাশয়বিহীন স্ত্রী কাঁকড়া (খোসা কাঁকড়া) ১৫-২০ দিন পুকুরে রেখে উপযুক্ত খাবার দিয়ে মোটাতাজা করা হয়, যাকে 'কাঁকড়া ফেটেনিং' বলে। কাঁকড়া সর্বভূক প্রাণী। এরা ছোট মাছ, সামুদ্রিক ক্রিমি, শামুক, ঝিনুক, পোকামাকড় এবং পচনশীল জৈব পদার্থ খায়। চালের কুড়া, গমের ভুষি, আটা, ফিস মিল ইত্যাদি মিশ্রণপূর্বক কাঁকড়ার খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। সাধারণত, বিকেলে বা সন্ধ্যায় ও রাতে প্রতিদিন ২-৩ বার খাবার সরবরাহ করা উচিত।
পানি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় জোয়ার-ভাটার প্রভাবে পুকুরের পানি পরিবর্তন করা যায়। নিয়মিত চুন ও সার প্রয়োগ এবং পানির গুণাগুণ রক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে কাঁকড়া অন্যত্র বের হয়ে যায় বা মারা যায়।
আহরণ ও বাজারজাতকরণ:
কাঁকড়া মজুতের ৩-৪ মাস পর আহরণ করা যায়। বাংলাদেশে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় মার্চ থেকে জুলাই মাস। কাঁকড়া ধরার জন্য বাঁশের চাই অথবা জালের তৈরি ফাঁদ সবচেয়ে উপযুক্ত। জীবন্ত কাঁকড়া চিমটা বা প্লাস্টিকের ফিতা দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে ঝুড়িতে ভরে বাজারজাত করা হয়। পরিবহনের সময় ঝুড়িতে স্যাঁতসেঁতে ভাব বজায় রাখার জন্য লবণ পানি ছিটিয়ে দিতে হয় এবং ঝুড়ি অন্ধকারে/ছায়াযুক্ত ঠান্ডা স্থানে রাখতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সিদ্ধ করা অথবা হিমায়িত কাঁকড়া বিদেশের বাজারে বাজারজাত করা হয় না, যা পরিবহন খরচ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
উপসংহার:
কাঁকড়া চাষের উপযুক্ত পরিবেশ আমাদের দেশের উপকূল অঞ্চলে থাকলেও এর চাষ এখনো তেমন প্রসার লাভ করেনি। কাঁকড়ার রপ্তানি বাজারদর বিবেচনায় এর চাষ বেশ লাভজনক, কারণ সঠিকভাবে চাষ করা গেলে প্রতি কেজিতে ৬০ টাকারও বেশি নীট লাভ করা যায়। এটি একটি লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বিষয়টি প্রদর্শনের জন্য দেশে কাঁকড়া খামার স্থাপন এবং সরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এটি দারিদ্র্য ও বেকারত্ব মোচনে সহায়ক হবে। জীবন্ত কাঁকড়া রপ্তানির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। কাঁকড়া চাষ এবং উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য এ দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। উপকূলীয় এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরোপিট এলাকায় পরিকল্পিত কাঁকড়া চাষ করে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করা যায়। কাঁকড়ার বাচ্চা সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরীণ খালসমূহে বেহুন্দী জাল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাঁকড়া সম্পদ বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্ট সবাই প্রত্যাশা করছেন।
আপনার মতামত লিখুন: