সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২

মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে সিদ্ধান্ত, ৯টিতে ভিন্নমত

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

আগস্ট ১, ২০২৫, ১০:৪৩ এএম

মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে সিদ্ধান্ত, ৯টিতে ভিন্নমত

ছবি- সংগৃহীত

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ এবং সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। তবে এই দুটিসহ মোট সাতটি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) কমিশন তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি সিদ্ধান্তে একাধিক দল ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছে।

এই ভিন্নমতগুলো জুলাই জাতীয় সনদে উল্লেখ থাকবে। দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা গতকাল শেষ হলেও জুলাই সনদ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। শিগগির এটি চূড়ান্ত করার পর সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু হতে পারে।

 

২৩ দিনের আলোচনায় ১৯ মৌলিক প্রস্তাব

সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা গতকাল শেষ হয়েছে। গত ৩ জুন থেকে শুরু করে মোট ২৩ দিন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করে কমিশন। এই সময়ে মৌলিক সংস্কারের ১৯টি প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে অন্তত নয়টি বিষয়ের সিদ্ধান্তে একাধিক দলের ভিন্নমত রয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, "আগামী কয়েক দিনের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হবে। এরপর তা দলগুলোকে দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে।"

৭টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও ভিন্নমত

গতকাল শেষ দিনের আলোচনায় যে সাতটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়, সেগুলো হচ্ছে:

  1. চার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ: (নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক ও ন্যায়পাল)

  2. উচ্চকক্ষ গঠন: (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি)

  3. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: (সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের গোপন ভোটে নির্বাচন)

  4. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা: (১২টি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা)

  5. নাগরিকের মৌলিক অধিকার: (সম্প্রসারণ, রক্ষা ও বাস্তবায়ন)

  6. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা: (কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা)

  7. সংবিধানের মূলনীতি: (বিদ্যমান চার মূলনীতি বহাল রাখা)

এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও মৌলিক অধিকার ছাড়া অন্য পাঁচটি বিষয়ে একাধিক দলের 'ভিন্নমত' আছে। সংবিধানের মূলনীতি ছাড়া বাকি চারটি প্রস্তাবে বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল ভিন্নমত দিয়েছে।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা

রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা যাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, সেজন্য সংবিধানে যেসব মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়েছিল, তার দুটি ছিল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পদ্ধতির বদল এবং পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন। কমিশনের এ দুটি প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি

এছাড়া ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর একটি প্রস্তাব দেয় ঐকমত্য কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়, তিন বাহিনীর (সেনা, নৌ ও বিমান) প্রধানসহ ১২টি প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে নিয়োগ দিতে পারবেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে না। তবে শেষ পর্যন্ত তিন বাহিনীর প্রধানসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। তিন বাহিনী প্রধানের নিয়োগ নির্বাহী বিভাগের হাতে রাখার পক্ষে মত দেয় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল। পরে অন্য সাতটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এক্ষেত্রেও দুটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ভিন্নমত দেয় বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল।

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংবিধানের মূলনীতি

গতকাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। এক্ষেত্রে কমিশন যে রূপরেখা প্রস্তাব করেছে, তার তিনটি ক্ষেত্রে বিএনপিসহ কয়েকটি দল ভিন্নমত দিয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়েও কমিশনের প্রস্তাবে ভিন্নমত দিয়েছে একাধিক দল। বিদ্যমান চার মূলনীতি বহাল রাখার নিশ্চয়তা না থাকায় সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশ জাসদ গতকালের বৈঠকের শেষ পর্যায়ে আলোচনা বর্জন করে।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও ভবিষ্যতের পথ

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার লক্ষ্যে ছয়টি কমিশনের যেসব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করা হবে। তবে এই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে জামায়াতে ইসলামী, নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) একাধিক দল। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের মন্তব্য করেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী হবে তা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক না হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যেতে পারে।

ড. আলী রীয়াজ জানান, কমিশন ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদের বিষয়ে আলোচনা শেষ করতে চেয়েছিল এবং দলগুলোর সহযোগিতার কারণে সেটা সফল হয়েছে। তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে কমিশন দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেছে এবং এ ক্ষেত্রে কমিশন অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করবে।

গতকালকের আলোচনা বৈঠকে কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান ও আইয়ুব মিয়া, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।