জুলাই ১৮, ২০২৫, ০৫:৩৪ পিএম
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ১০নং মোহনপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পলাশবাড়ী গ্রামের মেয়ে শান্তি মার্ডি, যিনি বাংলাদেশের নারী ফুটবল অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সমাজের পিছিয়ে পড়া সাঁওতাল পরিবারের এই আদিবাসী কিশোরী তার অদম্য জেদ আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্প্রতি অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে হ্যাটট্রিক করে বাংলাদেশের জন্য গৌরবময় জয় ছিনিয়ে এনেছেন। তার এই অর্জন শুধু একটি ম্যাচের জয় নয়, এটি অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম এবং সফলতার এক জীবন্ত উদাহরণ, যা গোটা জাতিকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
ভুটানের বিপক্ষে ৪-১ গোলের দুর্দান্ত জয়ে শান্তি মার্ডি একাই তিনটি গোল করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার এই অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্যে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের মূলপর্বে জায়গা করে নিয়েছে। এই জয়ের সুবাদে ফুটবল ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লেখা হয়েছে 'শান্তি মার্ডি' নামটি। শান্তির এই অর্জন কেবল দেশের মুখ উজ্জ্বল করেনি, তার জন্মভূমি বীরগঞ্জ ভাসছে আনন্দ আর গৌরবের জোয়ারে। শান্তির এই তিনটি গোল বাংলাদেশ নারী ফুটবলের ভবিষ্যতের স্বপ্নের পথচলা শুরু করেছে, যা প্রমাণ করে সঠিক সুযোগ পেলে প্রতিভা যেকোনো প্রতিবন্ধকতা জয় করে বিশ্বমঞ্চেও নিজেকে তুলে ধরতে পারে।
দশম শ্রেণির ছাত্রী শান্তি মার্ডি দক্ষিণ পলাশবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার বাবা বাবু লাল মার্ডি একজন দিনমজুর ও কৃষক, এবং মা সুকুরমনি মুরমু একজন গৃহিণী। পরিবারের দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে শান্তি মার্ডি দ্বিতীয়। আর্থিক অনটনের মাঝেও ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি শান্তির ছিল প্রবল টান। গ্রামের মেঠোপথ থেকে খেলা শুরু করে তিনি উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় অনূর্ধ্ব-২০ নারী দলে জায়গা করে নেন। এখন পর্যন্ত স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলায় অর্ধশতাধিক পুরস্কার অর্জনের সৌভাগ্য হয়েছে তার।
২০১৭ সালে শান্তি যখন দক্ষিণ পলাশবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন, তখনই আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বীরগঞ্জ উপজেলা। সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাজিম উদ্দীন ও স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক মোঃ নাজিরুল ইসলাম নাজিরের অনুপ্রেরণায় শুরু হয় শান্তি মার্ডির নতুন যাত্রা। উপজেলা, জেলা, বিভাগ—সবখানে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি জায়গা করে নেন বিকেএসপিতে। দারিদ্র্যতার মাঝে নানা প্রতিবন্ধকতা ও বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পেতে তাকে দিনের পর দিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই কঠিন সময়ে সহায়তা করেছেন বোদা ফুটবল একাডেমির পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বিপুল। তার প্রচেষ্টায়ই শান্তি মার্ডির পথচলার সোনালি অধ্যায় সূচিত হয়।
শান্তি মার্ডির বাবা বাবু লাল মার্ডি মেয়ের সাফল্যের পর দিনাজপুর টিভিকে জানান, "আমার মেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এটা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় পাওয়া।" আগামী দিনেও যেন দেশের সম্মান আরও উজ্জ্বল করে, সেজন্য তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। স্বল্প আয়ের সংসারে অভাব-অনটন থাকলেও মেয়ের খেলার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করেননি তারা। তবে বাড়িতে টিভি না থাকায় মেয়ের পুরো খেলা দেখতে না পারায় খুব খারাপ লেগেছে তাদের। মেয়ের সাফল্যে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন মা সুকুরমনি মুরমু।
স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক নাজিরুল ইসলাম বলেন, "শান্তি মার্ডি এখন কেবল একজন ফুটবলার নন, তিনি সাহস, সংগ্রাম আর স্বপ্নের নাম।" তিনি আরও বলেন, মানসম্মত খেলোয়াড় তৈরিতে প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা। মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিনুর রহমান চৌধুরী শাহিন এই কৃতি ফুটবলারের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেন এবং তাঁদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি শান্তি মার্ডির পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার ও এক বস্তা চাল উপহার হিসেবে তুলে দেন এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষায় শান্তি মার্ডির বাবা বাবু লাল মার্ডিকে একটি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড প্রদান করেন। ইউপি চেয়ারম্যান শাহিন চৌধুরীর এই উদ্যোগ সমাজের সমর্থন ও কৃতজ্ঞতাবোধকে তুলে ধরেছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার তানভীর আহমেদ বলেন, "শান্তি মার্ডিদের অর্জন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি এই এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরা তার এই অর্জনে গর্বিত।" তার ক্রীড়া নৈপুণ্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে যেকোনো প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন পরিবারটির পাশে থাকবে। প্রশাসন শান্তি মার্ডিকে সম্মানিত করার জন্য একটি সংবর্ধনার আয়োজনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বলেও জানান তিনি।
শান্তির এই সাফল্য শুধু তার নিজের নয়, এটি বাংলাদেশের নারী ফুটবলের ভবিষ্যতের সম্ভাবনার প্রতীক। তার গল্প এখন দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিটি মেয়ের চোখে নতুন স্বপ্নের আলো জ্বেলে দেয়। দক্ষিণ পলাশবাড়ীর শান্তি আজ শুধু একটি নাম নয়—সে একটি অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করেছে, প্রতিভা সুযোগ পেলে কোনো বাধাই থামাতে পারে না। নারী ফুটবলের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ একদিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় সাফল্য অর্জন করবে।