জুলাই ৩০, ২০২৫, ০৬:১৮ পিএম
মানবজীবনের প্রতিটি কর্মের পেছনে থাকে একটি অভ্যন্তরীণ প্রেরণা, যাকে আমরা নিয়ত নামে চিনি। নিয়ত যেমন একটি সাধারণ কাজকে ইবাদতে রূপ দিতে পারে, তেমনি ভুল নিয়ত একটি মহৎ কাজকেও মূল্যহীন করে দিতে পারে। তবে ইসলাম শুধুমাত্র নিয়তের পবিত্রতাকেই যথেষ্ট মনে করে না; বরং চায় কাজটির ধরন ও পদ্ধতিও হোক শরিয়তসম্মত এবং ভারসাম্যপূর্ণ।
নিয়ত ও আমলের ভারসাম্য: সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.)-এর ঘটনা
বিদায় হজের সময়ে সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.)-এর ঘটনা আমাদেরকে আমল কিভাবে করতে হবে তার একটি দিকনির্দেশনা দেয়। সংক্ষিপ্ত ঘটনাটি হলো:
বিদায় হজের সময় হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আশঙ্কায় তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিজের অধিকাংশ সম্পদ সদকা করার অনুমতি চান। কিন্তু রাসূল (সা.) তাকে তা করতে নিষেধ করেন। প্রথমে দুই-তৃতীয়াংশ, পরে অর্ধেক, এমনকি এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত আসার পরও রাসূল (সা.) বলেন, "এক-তৃতীয়াংশও অনেক বেশি।" অতঃপর বললেন, "সন্দেহ নেই, তোমার ওয়ারিসদেরকে তুমি যদি এমন অভাবীরূপে রেখে যাও, যার ফলে তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে, এ অবস্থার তুলনায় তাদেরকে তুমি সচ্ছলরূপে রেখে যাওয়া অনেক ভালো।" (বুখারি, হাদিস: ৪৪০৯)
এই হাদিস আমাদের শেখায়, শুধু নিয়তের পবিত্রতা যথেষ্ট নয়, বরং কাজটি হতে হবে শরিয়তসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ। সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.)-এর দান করার ইচ্ছা নিঃসন্দেহে ভালো ছিল, কিন্তু রাসুল (সা.) তাকে এমন পদ্ধতিতে দান করতে বললেন, যাতে পরিবারের হক বজায় থাকে এবং সমাজেও ভারসাম্য বজায় থাকে। তাই ইসলামে মৃত্যু পূর্ব দান বা ওসিয়তের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশে।
নিয়তের বিশুদ্ধতার প্রভাব
একই হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, "স্ত্রীর মুখে এক লোকমা তুলে দিলেও, যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়, তবে তাতেও সওয়াব রয়েছে।" এখানে আবার নিয়তের বিশুদ্ধতার প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। নিতান্তই ঘরোয়া বা সাধারণ কাজও মহান হয়ে উঠতে পারে যদি নিয়ত হয় খাঁটি।
অন্যদিকে, ভুল নিয়ত একটি ভালো কাজকেও মূল্যহীন করে দেয়। হাদিসে বলা হয়েছে, "আমলগুলো নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।" (বুখারি, হাদিস: ১) যে হিজরত আল্লাহ ও রাসুলের উদ্দেশ্যে, সেটিই প্রকৃত হিজরত। আর যে হিজরত কোনো নারী বা দুনিয়ার কারণে, তার হিজরত সেখানেই সীমাবদ্ধ।
আমলের পদ্ধতিও হতে হবে সঠিক
তবে শুধু নিয়ত নয়, পদ্ধতিও সঠিক হতে হবে। তিন সাহাবী যখন অধিক ইবাদতের উদ্দেশ্যে রাসুল (সা.)-এর পন্থা ছাড়িয়ে যেতে চাইলেন—একজন সারারাত নামাজ, একজন সারা বছর রোজা, আরেকজন বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন রাসুল (সা.) তাদের সংশোধন করলেন। বললেন, "আমি রোজা রাখি, ঘুমাই, নামাজ পড়ি, আবার বিবাহও করি। যে আমার সুন্নত থেকে বিমুখ, সে আমার দলভুক্ত নয়।" (বুখারি, হাদিস: ৫০৬৩)
কাজেই এমন কিছু কাজ আছে; যা দেখতে বৈধ, কিন্তু শরিয়তের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করার কারণে তা বিদআত হয়ে যায়। যেমন মৃতের জন্য নির্দিষ্ট দিনে কোরআনখানি ও মেজবান। রাসুল (সা.) বলেন, "যে কেউ আমাদের দ্বীনে এমন কিছু সংযোজন করে যা এতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।" (বুখারি, হাদিস: ২৬৯৭)
মোটকথা, যে কোনো আমল আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাইলে এ তিনটি বিষয় অপরিহার্য—নিয়তের বিশুদ্ধতা, আমলের বিশুদ্ধতা এবং কর্মপদ্ধতির বিশুদ্ধতা। পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকেও কোনো কাজের গ্রহণযোগ্যতার জন্যে সে কাজের শুদ্ধতা এবং এর শুদ্ধ কর্মপদ্ধতি অনিবার্য। এর কোনো একটি ছুটে গেলে কাঙ্কিত ফল হাসিল করা যায় না। আর আল্লাহ তায়ালা যেহেতু অন্তর্যামী, তিনি আমাদের মনের কোণে লুকায়িত ভাবনাটুকুও জানেন, সঙ্গত কারণেই তাঁর দরবারে গৃহীত হওয়ার জন্যে নিয়তের শুদ্ধতা অনিবার্য।
আল্লাহ আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ নিয়তে সঠিক আমলগুলো শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় সম্পাদন করার তাওফিক দান করুন।
আপনার মতামত লিখুন: