জুলাই ২৮, ২০২৫, ১২:৪৬ পিএম
এক সময়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ থেকে উঠে এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘সমন্বয়ক’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদ গত শনিবার (২৬ জুলাই) সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানে চাঁদাবাজির সময় চার সহযোগীসহ হাতেনাতে আটক হয়েছেন। আটকের পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং সংগঠন থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়।
রিয়াদের গ্রেপ্তারের পর তার নিজ জেলা নোয়াখালীতে, বিশেষ করে সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নের নবীপুর বাজার এলাকায়, তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, রিয়াদের পারিবারিক পটভূমি ছিল অত্যন্ত সাধারণ। তার দাদা এবং বাবা দুজনেই ছিলেন রিকশাচালক। পরে তার বাবা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতেন। মা নাজমুন নাহার ছিলেন গৃহিণী, এক সময় অন্যের বাড়িতেও কাজ করতেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট রিয়াদ। তার বড় ভাই চট্টগ্রামে একটি ফিশারিজ কোম্পানিতে চাকরি করেন।
রিয়াদের সহপাঠীরা জানান, তিনি স্থানীয় নবীপুর হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সরকারি মুজিব মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং সাবেক সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার হাতে ফুল দিয়ে ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপর সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় গিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এক পর্যায়ে তিনি কোটা বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন এবং ধীরে ধীরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হয়ে ওঠেন। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ধীরে ধীরে চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন।
রিয়াদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আগের ভাঙাচোরা পরিবেশ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আগের ঘরের পাশেই নির্মিত হচ্ছে পাকা ঘর। শুধু পাকা ঘর নির্মাণই নয়, রিয়াদ দামি গাড়িও কিনেছেন।
ছেলে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করেছেন—এমনটা রিয়াদের মা-বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। রিয়াদের মা নাজমুন নাহার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, "আমরা না খেয়ে ওকে শহরে পাঠাইছি। ছেলেটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, ভালোই ছিল। টিভিতে দেখি আমার ছেলেকে পুলিশে ধরেছে। শুনেছি সে নাকি চাঁদাবাজি করেছে। এটা আমার বিশ্বাস হয়না। আমার ছেলেকে কেউ ষড়যন্ত্র করে চাঁদাবাজ বানিয়েছে।"
রিয়াদের পাশের বাড়ির এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "রিকশা চালানোর মাধ্যমে যে পরিবার চলত, দিন এনে দিন খেতে হতো। সেখানে ৫ আগস্টের পর রিয়াদের বিলাসী জীবনযাপন, ছাদ ঢালাই করে পাকা বাড়ি নির্মাণ করা দেখে আমরা অবাক হয়েছি।"
জানা যায়, রিয়াদ ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক। গত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সমন্বয়ক পরিচয়ে তিনি চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন। গ্রামবাসী প্রশ্ন তুলছেন, একজন হতদরিদ্র রিকশাওয়ালা পরিবারের ছেলে সমন্বয়কের মুখোশ পরে কিভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন এবং বিলাসী জীবন যাপন করেন। যদিও তার ভয়ে এতদিন কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি।
নবীপুর হাই স্কুলের সাবেক সভাপতি শিহাব উদ্দিন বলেন, "আমার স্কুলের এই ছাত্রকে সবাই দান-খয়রাত করে পড়াত, কারণ তার দরিদ্র রিকশাচালক বাবার পক্ষে পড়ালেখার খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। সে কিভাবে এত ভয়ংকর চাঁদাবাজ হয়ে উঠল তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।"
সাধারণ পরিবার থেকে শহরে উঠে এসে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া এমন আরও রিয়াদ সমাজের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিনা, প্রশাসনকে তা খুঁজে বের করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা।
চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে আটক রিয়াদের ছবির ফ্রেমে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা রয়েছেন। ফেসবুকে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে তিনি নিজের শক্তির জানান দিতেন। তার ছবির ফ্রেমে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও বাদ যাননি; একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে তার ছবি পাওয়া গেছে তার ফেসবুকে।
আপনার মতামত লিখুন: