জুলাই ২৮, ২০২৫, ০৪:৫৩ পিএম
নওগাঁর সাপাহার উপজেলার খুটাপাড়া গ্রামে আনোয়ার, একজন ব্যবসায়ী যিনি চাকরির পাশাপাশি আম মৌসুমে তার পৈতৃক আম বাগানে কাজ করেন, স্মার্ট আম চাষের মাধ্যমে এক সফল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার ৫০ বিঘার বেশি পৈতৃক আম বাগান থেকে এই মৌসুমে ৭৫ লাখ টাকার আম বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বর্তমান বাজার মূল্যে প্রতি বিঘায় ১ থেকে ১.৫ লাখ টাকা আয়ের অনুমান করছেন। প্রতিটি গাছে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ মণ ফলন হতে পারে। এই বছর তার ৫০ বিঘা জমি থেকে মোট ২৫০০ মণ ফলন হবে বলে তিনি অনুমান করেছেন। আনোয়ার জোর দিয়ে বলেন যে, তাদের এই সাফল্য বাগানে কঠোর পরিশ্রম এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ মেনে আধুনিক চাষাবাদের ফল। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, নওগাঁ এখন উৎপাদনে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাগানে আম্রপালি, কলাবতী আম এবং বারিফোর জাতের আম রয়েছে। আম্রপালি ছোট ও বড় উভয় আকারের হতে পারে। নতুন গাছগুলো বড় আম উৎপাদন করে। তিনটি আম্রপালি আমের ওজন প্রায় ১২০০-১৩০০ গ্রাম হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি ১১৫-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আনোয়ার নতুন কৃষকদের জন্য আম্রপালি চাষের সুপারিশ করেন কারণ এর উচ্চ চাহিদা এবং ভালো ব্যবসা রয়েছে। আম্রপালির সর্বোচ্চ চাহিদা জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে থাকে। বারিফোর আমেরও উচ্চ চাহিদা রয়েছে। এর আকার ৫০০-৮০০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। দুটি বারিফোর আমের ওজন এক কিলোগ্রামের বেশি হতে পারে, কখনও কখনও একটি আমের ওজনও এক কিলোগ্রাম হয়। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে এর ফলন শুরু করা যায়। পাকা অবস্থায় আমটি লালচে হয়ে গোলাকার হয়। কলাবতী আমের রপ্তানির জন্য উচ্চ চাহিদা রয়েছে এবং এর রঙও সুন্দর। এর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এটি প্রতি বছর ফলন দেয়, কোনো বছর বাদ যায় না।
স্থানীয় আমের বাজার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ক্রমাগত বাড়ার সাথে সাথে এটি আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। নওগাঁ আম রপ্তানির চেষ্টা করছে, এবং কিছু আম ইতিমধ্যেই রপ্তানি করা হয়েছে। নওগাঁর আম লাল মাটির কারণে খুব মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়, যা ফল, বিশেষ করে আমের জন্য চমৎকার। আমের দাম দিন দিন দ্রুত বাড়ছে। সাপাহারের আম বিশ্বব্যাপী বিতরণ করা হয়।
আম গাছ ১২-১৪ বছর পর্যন্ত রাখা হয়। আম্রপালি এবং বারিফোর একসাথে রোপণ করলে একটানা ফলন পাওয়া যায়, কারণ একটি জাত শেষ হলে অন্যটি প্রস্তুত হয়। গাছগুলোর মধ্যে ১৫-১৬ ফুট দূরত্ব রাখা ভবিষ্যতের বৃদ্ধি এবং আলো-বাতাস চলাচলের জন্য আদর্শ বলে মনে করা হয়। বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত বৃষ্টির সময় সাদা মাছি এবং ছত্রাক আক্রমণ করতে পারে, যার জন্য সময়মতো ফসল তোলা জরুরি যাতে ভেতরের পচন রোধ করা যায়। "থ্রিপস" এর মতো কীটপতঙ্গ প্রতিরোধে সঠিক সময়ে স্প্রে করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত তাপের কারণে আম অকালে পেকে যেতে পারে। ফসল তোলার পর ছাঁটাই করা হয় এবং গাছের চারপাশে জৈব (গোবর) ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়। নতুন কুঁড়ি বের হলে দ্রুত বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন এবং পিজিআর (প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটর) দিয়ে স্প্রে করা হয়। গাছগুলোকে ঝোপালো, ছাতার মতো আকৃতিতে (মানুষের উচ্চতার সমান) ছাঁটাই করা হয় যাতে ফসল তোলা এবং স্প্রে করা সহজ হয়। এটি সূর্যের আলো প্রবেশ এবং ফলের পুষ্টি বিতরণেও সহায়তা করে। যদি গাছগুলো খুব বড় হয়ে যায় এবং শাখাগুলো একে অপরের সাথে জড়িয়ে যায়, তবে আলো-বাতাস চলাচলের উন্নতির জন্য একটি সারি কেটে ফেলা হতে পারে।
আনোয়ার স্প্রে করার সাত দিনের মধ্যে ফল না তুলে নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত করেন। ফসল তোলার পর আমগুলো আকার ও গুণমান অনুযায়ী (বড়/ভালো বনাম দাগযুক্ত/ছোট) বাছাই করা হয়। এরপর সেগুলো ক্রেট বা "গোল্ডেন হুড" বাক্সে প্যাক করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। অনলাইন বিক্রি ভালো হলেও, গ্রাহকরা প্রায়শই প্রক্রিয়াকরণ খরচের (ক্রেট, বাক্স, কুরিয়ার চার্জ) কারণে উচ্চ মূল্য নিয়ে অভিযোগ করেন। আনোয়ার জোর দিয়ে বলেন যে, তারা আম পাকানোর জন্য কার্বোহাইড্রেট (ক্যালসিয়াম কার্বাইড) ব্যবহার করেন না। তারা কাঁচা আম পাঠান যাতে পরিবহনের সময় নষ্ট না হয় এবং গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর ১-২ দিনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে পেকে যায়, যা দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণে সহায়তা করে। প্রাকৃতিকভাবে পাকা আমের একটি প্রধান সূচক হলো যে, সবগুলো আম একসাথে পাকে না, কারণ প্রতিটি ফলের পরিপক্কতা ভিন্ন হয়। ভালো ফলনের জন্য কীটনাশক এবং পিজিআর-এর সঠিক প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আম ব্যবসা সঠিকভাবে করলে লাভজনক হতে পারে, বিশেষ করে গাছের সঠিক পুষ্টি, বিশেষ করে গোবরের মতো জৈব সার সরবরাহ করে।
নওগাঁর আম, বিশেষ করে "নাগফজলি," জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) স্বীকৃতি পেয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন: