মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ছাগল ও গরুর খামার: সফলতার গল্প

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ২৮, ২০২৫, ০২:৫১ পিএম

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ছাগল ও গরুর খামার: সফলতার গল্প

দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার চাকবাগুলিয়া গ্রামের মনিরুজ্জামান ভাই ও তার স্ত্রীর সমন্বিত ছামারটি এখন সফলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রায় ছয়-সাত বছর আগে মাত্র ৩,৫০০ টাকায় একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল কিনে তারা এই খামারের যাত্রা শুরু করেছিলেন। বর্তমানে তাদের খামারে ১০০টিরও বেশি ছাগল এবং ১৮টি গরু রয়েছে। মনিরুজ্জামান ভাই পার্বতীপুরের একজন ব্যবসায়ী হওয়ায় তার স্ত্রী মূলত দিনের বেলায় ছাগল দেখাশোনা করেন, আর তিনি সকালে ও সন্ধ্যায় সহায়তা করেন।

ছাগল পালন: বর্তমানে খামারে ১০০টিরও বেশি ছাগল রয়েছে। এই বছর প্রায় ২৫টি ছাগল বিক্রি হয়েছে। তারা ব্ল্যাক বেঙ্গল দিয়ে শুরু করলেও এখন বিভিন্ন সংকর জাতের ছাগল পালন করছেন, যা ভালো দুধ উৎপাদন এবং সুস্থ বাচ্চা দেওয়ার উপর জোর দেয়। কিছু মা ছাগল একবারে তিনটি বাচ্চা দেয়। একটি নির্দিষ্ট মা ছাগল এ পর্যন্ত ২৭টি বাচ্চা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে তারা প্রজননের জন্য অন্যের পুরুষ ছাগল ব্যবহার করতেন, কিন্তু এখন তাদের নিজস্ব প্রজননক্ষম পুরুষ ছাগল রয়েছে, যা তাদের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে। একটি ছাগলের জন্য প্রায় ২ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন হয়। প্রতিদিন তিনবার (সকাল, দুপুর, রাত) ছাগলদের খাবার দেওয়া হয় এবং তাদের থাকার ও খাওয়ার জায়গা পরিষ্কার করা হয়।

মনিরুজ্জামান- সফল উদ্যোক্তা

একটি ছাগল প্রতিদিন প্রায় ২০ টাকার খাবার খায়। মালিক জোর দিয়ে বলেন যে, যদি ঘাস পাওয়া যায়, তবে খুব বেশি অন্য খাবারের প্রয়োজন হয় না, শুধু সামান্য পরিপূরক খাবারই যথেষ্ট। তারা প্রতি তিন মাস অন্তর পিপিআর ভ্যাকসিন এবং কৃমিনাশক ওষুধ প্রয়োগ করেন। কৃমিনাশকের পর জিঙ্ক দেওয়া হয় যাতে তাদের লোম স্বাস্থ্যকর থাকে। প্রতিটি মা ছাগল বছরে ৭,০০০ থেকে ৮,০০০ টাকা লাভ দিতে পারে। বর্তমানে প্রায় ৫০টি ছাগল বিক্রির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। মাংসের জন্য পুরুষ ছাগল প্রতি কেজি ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। বড় আকারের তরুণ ছাগলের দাম ১০,০০০ টাকা। খাসি ছাগল ১০ কেজি ওজনে পৌঁছালে বিক্রি করা হয়। মনিরুজ্জামান ভাই তার ছাগলগুলোকে নিজের সন্তানের মতো মনে করেন এবং প্রতিটি ছাগলের ডাক শুনেই তাদের চিনতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রাণীদের ভালোবাসলে তাদের উন্নতি হয়, মানুষের মতো তারা প্রতারণা করে না।

গরু পালন: খামারে ১৮টি গরু রয়েছে। তারা ফ্রিজিয়ান, শাহীওয়াল, ব্রাহমা এবং জার্সি সহ বিভিন্ন জাতের গরু পালন করেন। মনিরুজ্জামান ভাই প্রতিদিন প্রায় চার ঘণ্টা (সকাল ৭টা থেকে সকাল ১১টা) গরু পরিচর্যায় ব্যয় করেন, যার মধ্যে গোসল করানো, পরিষ্কার করা এবং খাবার প্রস্তুত করা অন্তর্ভুক্ত। তিনি রাতেও কাজ করেন, যার মধ্যে দুধ দোয়ানো এবং বাছুর পরিষ্কার করাও রয়েছে। তারা প্রতিদিন প্রায় ৩০ কেজি দুধ উৎপাদন করেন। দুধ স্থানীয় একটি ডেইরি ফার্মে বিক্রি করা হয়। বাছুর বিক্রি থেকে লাভ আসে। মশা ও মাছি তাড়াতে গ্লিসারিন পাউডার ব্যবহার করা হয়, যা গোয়ালঘরকে জীবাণুমুক্ত রাখে।

আর্থিক ও লাভজনকতা: ছাগল ও গরু উভয় থেকে বছরে প্রায় ৫,০০,০০০ টাকা লাভ হয়, সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে। কয়েকটি ছাগল বিক্রি করে পরিবারের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়।

চ্যালেঞ্জ ও সহায়তা: মনিরুজ্জামান ভাই পার্বতীপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে কোনো সহায়তা পাননি, যদিও তিনি একটি ডেইরি ফার্মের সদস্য এবং প্রশিক্ষণও পেয়েছেন। তিনি তার খামার নিবন্ধন করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সফল হননি, যা তাকে সরকারি ভ্যাকসিন, অনুদান বা ঋণ পেতে বাধা দেয়। ভিডিওতে স্থানীয় কৃষকদের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ এবং সহায়তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: তার স্বপ্ন ১০০টি মা ছাগল এবং ১০০টি গরু রাখা। তিনি আশা করেন যে, তার অবর্তমানেও তার ছেলেরা খামারটি ভালোভাবে পরিচালনা করবে।

আকাঙ্ক্ষী কৃষকদের জন্য পরামর্শ: কৃষকদের অবশ্যই তাদের প্রাণীদের, তা ছাগল হোক বা গরু, আন্তরিকভাবে ভালোবাসতে হবে। সঠিক যত্ন, খাবার এবং সময়মতো চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। প্রাণীদের প্রতি রাগ করা বা তাদের সাথে ঝগড়া করা যাবে না। ছাগলের খামার শুরু করার আগে একটি সঠিক পরিকল্পনা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে লাভজনকতা নিশ্চিত হয়। নারীরা তাদের গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি কয়েকটি ছাগল পালন করতে পারেন, যা পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে অবদান রাখবে।

মনিরুজ্জামান ভাই বলেন, "আল্লাহ আমার ১০০টি মা ছাগল এবং ১০০টি গরুর স্বপ্ন পূরণ করবেন। এটাই আমার স্বপ্ন। আমি মরে গেলেও, আমার ছেলেরা যদি ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারে, তা ছাগল হোক বা গরু, তাদের অবশ্যই ভালোবাসতে হবে। আপনি তাদের ভালোবাসা দিলে, তারা আপনাকে ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবে।" তিনি আরও বলেন, "পশু মানুষকে ধোঁকা দেয় না; মানুষ মানুষকে ধোঁকা দেয়। আপনি যদি একটি ছাগলকে মন থেকে ভালোবাসেন, আল্লাহ তাদের উন্নতি দান করবেন। কিন্তু আপনি যদি মানুষকে ভালোবাসেন, তারা আপনাকে ধোঁকা দেবে।" তিনি উল্লেখ করেন, "একটি ছাগল বেশি খায় না। যদি ঘাস থাকে, তবে আর কিছুর প্রয়োজন নেই। যদি ঘাস থাকে, তবে সামান্য পরিপূরক খাবারই যথেষ্ট।" তিনি আরও বলেন, "একটি মা ছাগল বছরে ৭,০০০ থেকে ৮,০০০ টাকা দেয়।" "যদি আমরা দুই-চারটি ছাগল বিক্রি করে কিছু টাকা উপার্জন করি, তবে তা আমাদের পরিবারের জন্য উপকারী, ক্ষতি নয়, লাভ।" তিনি নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, "যারা বাড়িতে থাকছেন, রান্নার ফাঁকে তারা দুই-চারটি ছাগল পালন করতে পারেন। এতে পরিবারের অবস্থা খারাপ হবে না, বরং উন্নত হবে।" তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, "আমার মনে হয় তারা আমার সন্তান। আমি বলতে পারি কোন ছাগল ডাকছে। আমার ১০০টি ছাগলের মধ্যে যদি একটি ডাকে, আমি বলতে পারি কোনটি, কারণ আমি তাদের কণ্ঠস্বর চিনতে পারি।" তিনি আরও বলেন, "আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ছাগল পালন করেছেন। বলা যায় এটি নবীর একটি সুন্নাহ। ছাগল পালন করলে আল্লাহর রহমত আসবে।" পরিশেষে তিনি বলেন, "ছাগলকে 'গরীবের গরু' বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, একজন স্বল্প আয়ের ব্যক্তিও ছাগল কিনে তার ভবিষ্যৎ লাভজনক করতে পারে।"