জুলাই ২৬, ২০২৫, ১০:০৬ এএম
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। খাদ্য, ঔষধ, জ্বালানি এবং অন্যান্য মৌলিক সরবরাহের অভাবে সেখানকার প্রায় ২৩ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। যুদ্ধ, অবরোধ এবং ত্রাণ বিতরণে প্রতিবন্ধকতার কারণে সৃষ্ট এই সংকট এখন একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে গাজার বাসিন্দাদের। সম্প্রতি জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) পক্ষ থেকে দেওয়া এক সতর্কবার্তা পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলেছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) এক চরম সতর্কবার্তা জারি করে জানিয়েছে, গাজার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কয়েকদিন ধরে অভুক্ত অবস্থায় দিন পার করছে। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, "অপুষ্টি বেড়েই চলেছে। ৯০ হাজার নারী ও শিশুর জরুরি চিকিৎসা দরকার।"
গাজায় চলমান সংঘাতে খাদ্য সংকটের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার অপুষ্টিতে ভোগা আরও ৯ জন মারা গেছে, যা নিয়ে এই ধরনের মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২২ জন।

গাজায় সমস্ত সরবরাহ প্রবেশ পথের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসরায়েল অবশ্য দাবি করছে যে, সাহায্য প্রবেশে কোনো বিধিনিষেধ নেই। তারা এই অপুষ্টির জন্য হামাসকে দায়ী করছে। ইসরায়েলের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা শুক্রবার বলেছেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বিমান থেকে সাহায্য বিতরণের অনুমতি দেওয়া হতে পারে, যদিও সাহায্য সংস্থাগুলো আগে সতর্ক করেছিল যে, এভাবে সাহায্য দেওয়া যথেষ্ট নয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডান এবার এভাবে সাহায্য দিতে পারে, তবে জর্ডানের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন যে, তারা এখনো ইসরায়েলের কাছ থেকে অনুমতি পাননি।
গাজার মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। শুক্রবার জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য অবিলম্বে গাজায় সকল বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এক যুক্ত বিবৃতিতে তারা অবিলম্বে যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয় অবসানের আহ্বান জানিয়ে বলেছে, ইসরায়েলকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, "বেসামরিক জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়াটা অগ্রহণযোগ্য।"
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস তার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বৈশ্বিক সমাবেশে তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকের মধ্যে যে পরিমাণ মতভিন্নতা, উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে – সহানুভূতি, সত্যতা ও মানবিকতার অভাব – তার মাত্রা তিনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। তিনি আরও জানান, ২৭শে মে থেকে খাদ্য পাওয়ার জন্য চেষ্টা করার সময় এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
জাতিসংঘের নেতৃত্ব যখন খাদ্য বিতরণের বিকল্প হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) খাদ্য বিতরণ শুরু করে, তখন থেকেই এসব ঘটনা ঘটছে। জিএইচএফ-এর সাথে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক একজন ঠিকাদার অ্যান্থনি আগুইলার বিবিসিকে বলেছেন, 'তিনি প্রশ্নহীনভাবেই যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হতে দেখেছেন'। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) এবং মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা গোলাবারুদ, মর্টার ব্যবহার করছেন এবং খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে ট্যাংক থেকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি বর্ষণ করছেন।
অবসরপ্রাপ্ত এই সৈনিক বলেন, "আমার পুরো ক্যারিয়ারে এমন মাত্রার নিষ্ঠুরতা দেখিনি। আইডিএফ ও মার্কিন ঠিকাদারদের হাতে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে ও অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ দেখেছি।" জিএইচএফ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, এগুলো একজন ক্ষুব্ধ সাবেক ঠিকাদারের কাছ থেকে এসেছে, যাকে অসদাচরণের অভিযোগে এক মাস আগে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল কাতার আলোচনা থেকে তাদের দল প্রত্যাহার করে নেওয়ায় নতুন যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির আলোচনা এখনো অনিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, হামাস সত্যিকার অর্থে সমঝোতা চায়নি। তিনি মন্তব্য করেছেন, "আমি মনে করি তারা মরতে চায়।" যুক্তরাষ্ট্রের এমন মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছে হামাস। হামাসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বিবিসি গাজা সংবাদদাতাকে বলেছেন, মধ্যস্থতাকারীরা জানিয়েছেন যে আলোচনা একেবারে ভেঙে পড়েনি এবং ইসরায়েলি দল আগামী সপ্তাহে দোহায় ফিরবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর ইসরায়েল গাজায় অভিযান শুরু করেছিল, যেখানে হামাসের হামলায় ১২শ মানুষ নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি করা হয়েছিল। এরপর ইসরায়েলের হামলায় ৫৯ হাজার মানুষ গাজায় মারা গেছে বলে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। ইসরায়েল মার্চের শুরু থেকে খাদ্য সহায়তার ওপর অবরোধ আরোপ করে এবং এরপর দুই মাসে যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটিয়ে আবারো হামলা শুরু করে। এরপর অবরোধ কিছুটা শিথিল হলেও বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞরা সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে খাদ্য, ঔষধ ও জ্বালানির তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
গাজার বেশিরভাগ মানুষ কয়েকবার করে ঘরবাড়ি হারিয়েছে এবং ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে।
এই পরিস্থিতির মাঝেই বৃহস্পতিবার ফ্রান্স বলেছে, তারা সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এরপর যুক্তরাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ এমপি দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে একই পথ অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে স্যার কিয়ের স্টারমার শিগগিরই এ ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "এটা হতে পারে বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ, যার চূড়ান্ত ফল হবে দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান।"
আপনার মতামত লিখুন: