জুলাই ২১, ২০২৫, ০৬:৪৪ পিএম
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় যখন দেশজুড়ে শোকের মাতম, ঠিক তখনই এক মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আহতদের জীবন বাঁচাতে রক্তদানের জন্য জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মানুষের ঢল নেমেছে। এই ভয়াবহ মুহূর্তে অসংখ্য মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে ছুটে এসেছেন, যা দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছে এবং জাতীয় ঐক্য ও সহানুভূতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
সোমবার (২১ জুলাই, ২০২৫) বিকেলে আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিত্র ছিল অভাবনীয়। হাসপাতালের গেটের বাইরে রক্তদাতাদের দীর্ঘ সারি, অনেকে আবার একসঙ্গে একাধিকজনকে নিয়ে এসেছেন। দগ্ধদের মধ্যে অন্তত ৫০ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে, যাদের অনেকেই ৫০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছেন। তাদের জীবন বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে প্রচুর রক্তের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন রক্ত দিতে।
মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, মানুষের মধ্যে এক ধরনের আবেগ ও আকুতি কাজ করছে— যে কোনো মূল্যে আহতদের পাশে দাঁড়ানো। রক্তদাতা আশরাফুল ইসলাম জানান, "সংবাদ দেখে আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। বাসা থেকে স্ত্রীকেও সঙ্গে এনেছি। উনি ও পজিটিভ, আমি বি নেগেটিভ— যার যেখানে দরকার হবে, রক্ত দিতে রাজি আছি।" তার এই উক্তি প্রমাণ করে, এই দুঃসময়ে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সহানুভূতির এক প্রবল প্রবাহ তৈরি হয়েছে।
বার্ন ইনস্টিটিউট সূত্র জানিয়েছে, পজিটিভ রক্তের পর্যাপ্ত সংখ্যক ডোনার থাকলেও, নেগেটিভ গ্রুপগুলোর রক্তের, বিশেষ করে O-নেগেটিভ এবং B-নেগেটিভ রক্তের, সংকট দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন রক্তদান সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ রক্তের গ্রুপ উল্লেখ করে আবেদন পোস্ট করছেন এবং সেগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ফলস্বরূপ, হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী রক্ত দিতে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভিড় করছেন।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, দুর্যোগের সময় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার যে গভীর প্রবণতা রয়েছে, তা যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় অপরিহার্য। এটি কেবল রক্তদান নয়, বরং একটি জাতি হিসেবে আমাদের সংহতি ও মানবিকতার পরিচায়ক।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করা বিমানটি মাত্র ১২ মিনিট পর, ১টা ১৮ মিনিটে, দুর্ঘটনার শিকার হয়। এই ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই কোমলমতি শিক্ষার্থী।
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পাশে দাঁড়াতে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে রক্তদাতাদের এই ঢল নিঃসন্দেহে দেশের মানবিকতাকে তুলে ধরে। এটি প্রমাণ করে যে, সংকটকালে দেশের আপামর জনগণ দল-মত নির্বিশেষে একতাবদ্ধ হতে পারে। তবে, এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, ভিড় নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং সুনির্দিষ্টভাবে রক্তের গ্রুপ চিহ্নিত করে ডোনারদের আহ্বান জানানোর ব্যবস্থা না থাকলে তা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতে এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে রক্ত সংগ্রহ ও বিতরণে আরও সুসংগঠিত এবং ডেটা-চালিত পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। প্রতিটি গ্রুপের রক্তের চাহিদা এবং সরবরাহের একটি ডিজিটাল ডেটাবেজ থাকলে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। পাশাপাশি, স্বেচ্ছাসেবকদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার মাধ্যমে ভিড় নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক ডোনারের রক্ত সংগ্রহের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় জাতির মধ্যে যে গভীর শোকের সৃষ্টি হয়েছে, বার্ন ইনস্টিটিউটে রক্তদাতাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সেই শোককে মানবিকতার শক্তিতে রূপান্তরিত করেছে। এটি বাংলাদেশের মানুষের সহমর্মিতা, সংহতি এবং দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রতিফলন। এই মানবিকতার দৃষ্টান্ত কেবল আহতদের জীবন বাঁচাতেই সাহায্য করছে না, বরং একটি দুর্যোগের মুহূর্তে জাতিকে নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টাই প্রমাণ করে, যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের মানুষ সবসময় একে অপরের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত।
আপনার মতামত লিখুন: