বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

আজও আপসহীন, বিএনপির ভরসার বাতিঘর খালেদা জিয়াই

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ৩০, ২০২৫, ১২:৩২ পিএম

তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর দলের নেতৃত্বে আসা বেগম খালেদা জিয়া এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অবিচ্ছেদ্য নাম। শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগলেও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে তিনি এখনও 'আপসহীন নেত্রী' এবং বিএনপির 'ভরসার বাতিঘর' হিসেবে বিবেচিত। সরাসরি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় না থাকলেও, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও কৌশলগত পরামর্শে তার 'নীরবে অন্তরালের কূটনীতি' দলের বড় আত্মবিশ্বাসের জায়গা হয়ে উঠেছে।

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়া এখন আর সরাসরি দলীয় কর্মসূচিগুলোতে অংশ নিতে পারছেন না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বয়স ও অসুস্থতার কারণে তার সশরীর উপস্থিতি না থাকলেও, দীর্ঘদিনের নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা এবং কৌশলগত কূটনীতির কারণে তিনি এখনও দেশের রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। বিএনপি নেতারা নিশ্চিত করেছেন যে, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার সঙ্গে পরামর্শ করেন। এছাড়া, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিয়মিত তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ নেন। তার অভিজ্ঞতা এবং সিদ্ধান্ত এখনও দলের ভেতরে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

২০১৮ সালে একটি 'মিথ্যা মামলায়' দণ্ড দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠায়। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। শর্ত অনুযায়ী তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও, গত বছরের ৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে তার দণ্ড মওকুফ করে মুক্তি দেন। এরপর থেকে তার রাজনৈতিক উপস্থিতির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

মুক্তি পাওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য রাখছেন। সর্বশেষ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বক্তব্য রেখেছিলেন এবং জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। ১১ জুলাই তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জনপ্রিয় লালন শিল্পী ফরিদা পারভীনের খোঁজখবর নেন। সর্বশেষ উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন, যার প্রেক্ষিতে বিএনপি নেতারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানান।

কূটনৈতিক পর্যায়েও খালেদা জিয়ার সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২১ জুলাই তার গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূত দাশো খারমা হামু দর্জি। এর আগেও তার সঙ্গে যুক্তরাজ্য, নেপাল, পাকিস্তান, চীন ও সৌদি আরবের কূটনীতিকরা সাক্ষাৎ করেছেন। এসব সৌজন্য বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় বলে বিএনপি সূত্র জানায়।

বিএনপির পররাষ্ট্র উইংয়ের একজন নেতা লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার বৈঠকের পেছনে খালেদা জিয়ার ভূমিকাকে তার 'নীরব কূটনীতি'র অন্যতম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও কৌশলী দৃষ্টিভঙ্গি সেই বৈঠক আয়োজনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল বলে তিনি দাবি করেন।

অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর মতে, "উনার তো দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, প্রচুর স্যাক্রিফাইস এবং কষ্টও আছে। কাজেই বাংলাদেশ নিয়ে উনার যে উপলব্ধি, অন্যদের সেইভাবে থাকার কথা না।" তিনি আরও যোগ করেন, অসুস্থ থাকলেও খালেদা জিয়া রাজনীতি এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখেন, যা বিএনপির জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।

খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে কখনও নির্বাচনে পরাজিত হননি। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে তিনি একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতে জয়লাভ করেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি অংশ নিতে পারেননি এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করে। ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচনের বাইরে রয়েছেন খালেদা জিয়া। তবে, বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যগতভাবে বর্তমান অবস্থায় থাকলেও সম্ভাব্য ২০২৬ সালের ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে তার অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এক্ষেত্রে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের আসন থেকে তিনি অংশ নিতে পারেন। এটি হলে জিয়া পরিবার থেকে এই প্রথম একাধিক সদস্য (তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া) নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।

যদিও এই বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখনই মন্তব্য করার সময় আসেনি বলে উল্লেখ করেছেন, তবে খালেদা জিয়ার নীরব উপস্থিতি এবং তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা যে এখনও বিএনপির জন্য এক অপরিহার্য শক্তি, তা বলাই বাহুল্য।