সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২

সবচেয়ে সুখী মানুষ হওয়ার শিক্ষা নবীদের জীবন থেকে

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ২১, ২০২৫, ১০:৪৯ এএম

সবচেয়ে সুখী মানুষ হওয়ার শিক্ষা নবীদের জীবন থেকে

ছবি- সংগৃহীত

পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুখী কারা ছিলেন, তা নিয়ে প্রায়শই প্রশ্ন জাগে। ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, নবী-রাসুলগণই ছিলেন সর্বকালের সবচেয়ে সুখী মানুষ। যদিও তাঁদের জীবন ছিল অন্য যেকোনো মানুষের চেয়ে বেশি কষ্ট, নির্যাতন এবং পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভরা, তবুও তাঁরা অন্তরে এক অতুলনীয় শান্তি ও তৃপ্তি অনুভব করতেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে তাঁদেরকে অসংখ্য দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের মতো অসুখ, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, তৃষ্ণার মতো জীবন-যন্ত্রণাও তাঁদের ছিল।

নবী-রাসুলগণের জীবনচরিত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁদের কষ্ট অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ ছিল। একবার হযরত মুহাম্মদ (সা.) এত তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন যে তাঁর কপাল ঘামে ভিজে গিয়েছিল এবং তিনি প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছিলেন। এ সময় একজন সাহাবি তাঁর প্রবল অসুখের কথা বললে নবীজি (সা.) উত্তর দেন, "হ্যাঁ, আমি যখন অসুস্থ হই, তখন আমার কষ্টের তীব্রতা অন্য মানুষের তুলনায় দ্বিগুণ হয়।" (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৬৫২)

শুধু রোগ নয়, তাঁরা ক্ষুধারও শিকার হয়েছিলেন। একবার নবীজি (সা.) তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন এবং দেখলেন হযরত আবুবকর (রা) ও ওমর (রা.) বাইরে আছেন। তিনি তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, "এই সময়ে তোমরা কী কারণে বাড়ি থেকে বের হলে?" তাঁরা বললেন, "ইয়া রাসুলুল্লাহ, ক্ষুধার কারণে।" নবীজি (সা.) তখন বললেন, "আমার জীবন যাঁর হাতে, সেই আল্লাহর কসম, আমিও সেই একই কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি।" (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২,৯৭৮)

দ্বীনের দাওয়াতে অবিচল ধৈর্য:

দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে নবী-রাসুলগণ আপনজনদের থেকেও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তবে তাঁদের হৃদয় ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তাঁরা মানুষের প্রতি ছিলেন উদার। তাঁদের পরাজয় বিজয়ে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ধৈর্য ধরেছিলেন। তাঁদের জীবনের এই দৃঢ়তা ও সৌন্দর্য সত্যিই আশ্চর্যজনক।

কষ্টের মধ্যেও অসাধারণ সন্তুষ্টির উদাহরণ:

মহানবী (সা.)-এর জীবনে এই অসাধারণ সন্তুষ্টির উদাহরণ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, এমনকি যখন তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তখনও। তায়েফের ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি তায়েফের মানুষের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা শুধু তাঁর আহ্বান প্রত্যাখ্যানই করেনি, বরং তাঁকে পাথর ছুঁড়ে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য শহরের শিশু ও দুষ্টুদের লেলিয়ে দিয়েছিল।

নিজের রক্তে ভিজে যাওয়া জুতা, রঞ্জিত ও ধুলামলিন দেহ নিয়ে যখন তিনি শহর ত্যাগ করছিলেন, তখনও তিনি আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করছিলেন, "হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আমার দুর্বলতা, আমার সম্পদের অভাব এবং মানুষের সামনে আমার অপারগতার কথা জানাই। হে সবচেয়ে দয়ালুদের সবচেয়ে দয়ালু, হে দুর্বলদের প্রভু এবং আপনি তো আমারও প্রভু, আপনি আমাকে কার কাছে সঁপেছেন? এমন লোকদের কাছে যাঁরা আমাকে শত্রু ভেবেছেন? নাকি এমন শত্রুর কাছে, যাঁদের আপনি আমার ওপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন? যতক্ষণ না আপনি আমার প্রতি ক্রোধান্বিত হন, ততক্ষণ আমি কারও পরোয়া করি না। আপনার অনুগ্রহ থাকলে আর কিছু চাই না। আমি আপনার চেহারার আলোতে আশ্রয় চাই, যার দ্বারা সব অন্ধকার দূর হয়। আমি শুধু আপনার সন্তুষ্টি চাই।"

পরীক্ষা ও সত্যিকারের বিশ্বাস:

আল্লাহর প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাসই হৃদয়ে এই ধরনের সন্তুষ্টি ও সুখ নিয়ে আসে। এর অর্থ এই নয় যে বিশ্বাসীর জীবন কাঁটামুক্ত হবে। আল্লাহ এই জীবনকে পরীক্ষার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন, "তিনি সেই সত্তা, যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য যে তোমাদের মধ্যে কারা সৎকর্মে উত্তম হবে।" (সুরা মুলক: আয়াত: ২)

জীবন বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী—উভয়ের জন্যই পরীক্ষা। পাপীদের জন্য যেমন পরীক্ষা, তেমনি পুণ্যবানদের জন্যও। যতক্ষণ তাঁরা জীবিত থাকবেন, পরীক্ষার ভেতরই থাকবেন। কিন্তু নবী-রাসুল ও কিতাব পাঠানোর উদ্দেশ্য শুধু পরকালে সুখ অর্জনের পথ দেখানো নয়, বরং এই জীবনেও শান্তি পাওয়ার পথ দেখানো। তাই দেখা যায়, বিশ্বাসী ব্যক্তি এই দুনিয়াতেও সত্যিকারের সুখী জীবন যাপন করে। কেননা, সত্যিকারের সুখ কেবল আল্লাহকে বিশ্বাস এবং তাঁর জ্ঞান থেকেই আসতে পারে।

সুতরাং, নবীগণ ছিলেন বিশ্বাসীদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং তাঁদের জীবনও ছিল সবচেয়ে সুখী ও শান্তিময়, যা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে পরিপূর্ণ।