সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২

দুই চোখে ৬টি অপারেশন করেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাননি মবিন

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ২১, ২০২৫, ০১:২০ পিএম

দুই চোখে ৬টি অপারেশন করেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাননি মবিন

ছবি- সংগৃহীত

মবিন শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার বড় শিধলকুড়া গ্রামের মৃত মোফাজ্জল হোসেন ও নাজমা বেগমের ছোট ছেলে। তার বড় ভাই জুলহাস বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, আর মেঝো ভাই মো. পলাশ পেশায় ড্রাইভার। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে দুই বছর আগে মবিন রাজধানী ঢাকার উত্তরা রাজলক্ষ্মী এলাকার একটি কম্পিউটারের দোকানে চাকরি নেন। গত বছর জুলাই মাসে যখন দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে, তখন পরিবারের শত চিন্তা উপেক্ষা করে তিনিও শিক্ষার্থীদের মিছিলে যোগ দেন, একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়।

মাঠ পর্যায়ের তথ্যানুযায়ী, গত বছর ১৮ জুলাই বেলা ১১টার দিকে মবিন যে মিছিলটিতে ছিলেন, সেটি উত্তরা থানার দিকে এগোলে আকস্মিকভাবে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া ২০০টির অধিক ছররা গুলি তার মুখমণ্ডলে এসে বিদ্ধ হয়। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। রক্তাক্ত অবস্থায় সড়কে লুটিয়ে পড়লে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সহায় সম্বলহীন মবিনের পরিবার তার চিকিৎসার জন্য প্রায় ২ লাখ টাকা ঋণ করে খরচ করে। টাকার অভাবে কিছুদিন চিকিৎসা বন্ধ থাকলেও, স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সহায়তায় পরে সরকারিভাবে তার চিকিৎসা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত তার দুই চোখে ৬টি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেনি। তবে চিকিৎসকরা আশা দিয়েছেন, আরও দুটি অপারেশনের পর তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মবিনের মতো অসংখ্য আহত ও নিহত মানুষের জীবনের গল্প জুলাই আন্দোলনের গভীর প্রভাবকে তুলে ধরে। মবিনের বড় ভাই মো. পলাশ জানান, আন্দোলনে অনেকেই গুম বা খুন হয়েছেন এবং অনেকে তাদের পরিবারকে খুঁজেও পাননি। তারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করেন যে মবিনকে ফিরে পেয়েছেন। তাদের এখন মূল চাওয়া, জুলাই আন্দোলনে যারা আহত ও নিহত হয়েছেন, তাদের যেন সরকারিভাবে একটি মর্যাদা দেওয়া হয়। তারা আশা করেন, সরকার আহতদের জন্য এমন কিছু করবে যাতে তারা ভালোভাবে বাঁচতে পারে, কারণ তাদের জীবন আর আগের মতো হবে না।

বিভিন্ন সূত্রমতে, মবিনের মা নাজমা বেগম জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর তার এই দুই ছেলে ছিল উপার্জনের শেষ ভরসা। ছোট ছেলে জুলাই আন্দোলনে গিয়ে আহত হয়ে দুই চোখ হারিয়েছে এবং মেঝো ছেলের সামান্য উপার্জনে কোনো রকম সংসার চলছে। বড় ছেলে বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। মবিনের সিএমএইচ হাসপাতালে সরকারিভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা হলেও, ঢাকায় যাতায়াতের খরচ বহন করতে তাদের খুবই কষ্ট হয়। সরকারের কাছে তার আকুল আবেদন, যাতায়াত খরচ এবং একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিলে তারা ভালোভাবে থাকতে পারতেন।

মবিন নিজে জানান, তিনি দোকান বন্ধ করে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, কারণ তার মন সায় দিচ্ছিল না। গোলাগুলির মধ্যে ছাত্রলীগের হামলার সময় থানার কাছাকাছি পৌঁছালে ছররা গুলি তার মাথায় লাগে। এখনো তার মাথায় দেড় শতাধিক গুলির চিহ্ন রয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণের পর তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। ১০ দিন পর টাকার অভাবে বাড়ি ফিরলেও, সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্ররা তাকে সিএমএইচে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। সিএমএইচে চিকিৎসার পর তিনি বাম চোখে সাদা-কালো আলো দেখতে পান। মবিন বলেন, "আমি চোখে দেখতে পাই না। তবে আমি চাই যারা চোখে দেখতে পায়, তারা যেন নতুন এক বাংলাদেশ দেখতে পায়। কোনো স্বৈরাচার ও খুনি যেন ক্ষমতায় থাকতে না পারে, এটাই আমি চাই।"

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শরীয়তপুরের সংগঠক ও মিডিয়া সেলের সম্পাদক মাহবুব আলম জয় জানান, মবিনরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য নিজেদের চোখ বিলিয়ে দিয়েছে। তিনি মনে করেন, এখনো বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা যায়নি এবং সরকারি-বেসরকারি অফিসে ক্ষমতাধররাই সুবিধাভোগী। তিনি বলেন, হাসিনা সরকার পতনের পর মবিনরা চেয়েছিল সিস্টেম পরিবর্তন হবে, এবং তারা একটি সুন্দর বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিল। তার স্বপ্ন সেই বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।

 

শরীয়তপুর