জুলাই ১৮, ২০২৫, ১২:১৮ পিএম
একসময় সোনালি আঁশ পাটের চাষের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল উত্তরের জেলা দিনাজপুর। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই চিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে। জেলার কৃষকদের মধ্যে পাট চাষে আগ্রহ ক্রমশ কমছে এবং তারা ধান, ভুট্টা, সবজি ও অন্যান্য অর্থকরী ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, ন্যায্য মূল্য না পাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব—বিশেষ করে পাট পচানোর জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাব—এসবই পাট চাষে কৃষকদের অনীহার প্রধান কারণ।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে দিনাজপুরে পাটের আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমাগত কমছে। কৃষকরা বলছেন, বাজারে পাটের ভালো দাম না পাওয়ায় তারা লোকসানের মুখে পড়ছেন। যখন পাট উৎপাদন করে লাভ নিশ্চিত করা যায় না, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা এমন ফসল বেছে নিচ্ছেন যা তাদের জন্য অধিক লাভজনক।
পাট চাষের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
-
উচ্চ উৎপাদন খরচ: পাট চাষে জমি তৈরি থেকে শুরু করে বীজ বপন, পরিচর্যা, কাটা এবং আঁশ ছাড়ানো পর্যন্ত শ্রমিক ও অন্যান্য উপকরণের খরচ বেড়েছে। একজন দিনমজুরের দৈনিক হাজিরা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা হওয়ায়, এক বিঘা জমির পাট উৎপাদন করে ঘরে তুলতে যে পরিমাণ খরচ হয়, তাতে মণপ্রতি পাটের দাম ১ হাজার টাকার ওপরে চলে যায়। কিন্তু বাজারে পাটের দাম অনেক সময় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত হওয়ায় কৃষকদের লাভ থাকে না।
-
পাট পচানোর জন্য পানির সংকট: ভরা বর্ষার মৌসুমেও দিনাজপুরের অনেক খাল-বিল, ডোবা ও পুকুর পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পাট কাটার পর তা জাগ দিতে গিয়ে কৃষকরা চরম বিপাকে পড়ছেন। পানির অভাবে পাট সঠিক নিয়মে জাগ দিতে না পারলে আঁশের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে কৃষকরা পাটের প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। অনেক কৃষককে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি সেচ করে পাট জাগ দিতে হচ্ছে, যা তাদের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
-
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: অনাবৃষ্টি এবং আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার কারণে পাটের ফলনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় পাট গাছ সঠিক বৃদ্ধি পাচ্ছে না, আবার অনেক সময় প্রচণ্ড রোদে গাছ লালচে হয়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে কৃষকরা পাটের পরিবর্তে অন্য লাভজনক ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। দিনাজপুরে ধান, ভুট্টা, আলু, কলা এবং বিভিন্ন আগাম জাতের সবজির আবাদ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকরা এখন এক ফসল উঠতে না উঠতেই আরেকটি ফসলের বীজ রোপণ করছেন, যা জমিকে তিন থেকে চার, এমনকি অনেক এলাকায় পাঁচ ফসলি জমিতে পরিণত করেছে। বিশেষ করে ভুট্টা চাষে কৃষকরা বেশি আগ্রহী হচ্ছেন, কারণ এতে লাভ বেশি এবং ফলনও ভালো। কলা চাষেও খরচ কম ও ভালো দাম পাওয়ার কারণে কৃষকরা ঝুঁকছেন।
কৃষি বিভাগের মতে, কৃষকদের বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকে যাওয়া জেলার কৃষি অর্থনীতিতে একটি নতুন ধারা তৈরি করছে। তবে এটি পাটের মতো ঐতিহ্যবাহী এবং গুরুত্বপূর্ণ ফসলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করছে। যদি পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ ধরে রাখতে না পারা যায়, তবে এটি দিনাজপুরের মাটি থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে পারে। তাই পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ, সহজ শর্তে ঋণ ও পাট পচানোর পানির সুব্যবস্থা করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
আপনার মতামত লিখুন: