শুক্রবার, ০১ আগস্ট, ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

ইউটিউব অ্যালগরিদমের আড়ালে এক গোপন জগৎ

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ৩১, ২০২৫, ১০:১৪ পিএম

ইউটিউব অ্যালগরিদমের আড়ালে এক গোপন জগৎ

ছবি- সংগৃহীত

ইউটিউব বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম। সাধারণত, আমরা ইউটিউবকে দেখি জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার, ভাইরাল ভিডিও এবং কোটি কোটি ভিউয়ের একটি জগত হিসেবে। কিন্তু এর আড়ালে যে একটি বিশাল, নিঃশব্দ ও ব্যক্তিগত জগৎ লুকিয়ে আছে, তা প্রায়শই আমাদের অজানা থাকে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় এই গোপন জগতের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে, যা ইউটিউবের প্রকৃত ব্যবহারবিধি এবং এর অ্যালগরিদমের সীমাবদ্ধতাকে নতুন করে সামনে এনেছে।

২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল ইউটিউবের প্রথম ভিডিও পোস্ট করা হয়েছিল। মাত্র ১৯ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে ইউটিউবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা একটি চিড়িয়াখানায় দাঁড়িয়ে হাতির কথা বলছিলেন। আজ ২০ বছর পর ইউটিউব দাবি করে—তারা এখন হলিউডের বিকল্প। বিশ্বের এক নম্বর স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ইউটিউব এখন প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন ঘণ্টা দেখা হয়। ইউটিউব তারকাদের জনপ্রিয়তা পেছনে ফেলেছে অনেক বড় প্রোডাকশন হাউসকেও।

তবে ইউটিউবের এই ঝলমলে, পেশাদার এবং মুনাফামুখী চেহারার আড়ালে আছে আরেকটি বাস্তবতা—একটি গভীর, নিঃশব্দ জগৎ, যেখানে কোটি কোটি ভিডিও প্রায় কেউই দেখে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনিশিয়েটিভ ফর ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচারের জ্যেষ্ঠ গবেষক রায়ান ম্যাকগ্রাডি বলেন, ‘আমরা যখন শুধু জনপ্রিয় ভিডিও নিয়ে কথা বলি, তখন আমরা ভুলে যাই ইউটিউবের প্রকৃত ব্যবহারকারীরা কেমন করে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করেন।’

গবেষকরা এক ধরনের টুল বানান যা ইউটিউবের ভিডিও ইউআরএলগুলো র্যান্ডমভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজে বের করে। এইভাবে প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ইউআরএল ট্রাই করার পর তারা ইউটিউবের একটি বাস্তবচিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হন।

তাদের গবেষণায় উঠে আসে—ইউটিউবের একটি ভিডিওর গড় ভিউ মাত্র ৪১। আর যেসব ভিডিওর ভিউ ১৩০-এর বেশি, সেগুলো ইউটিউবের শীর্ষ ৩৩ শতাংশ কনটেন্টের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ বাকি বিপুল সংখ্যক ভিডিও প্রায় অদৃশ্য।

এই অদৃশ্য জগতে যা দেখা যায়, তা অনেকটা ডিজিটাল দালানে জমা স্মৃতির মতো। এখানে কেউ তার ছেলের জন্মদিনের ভিডিও আপলোড করেছে শুধু সংরক্ষণের জন্য। কেউ পোষা কুকুরের মৃত্যুর কথা জানাতে ক্যামেরা চালু করেছে। কোনোটিতে এক বৃদ্ধা নিজে রান্না করতে করতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কিছু বলছেন।

গবেষক ইথান জাকারম্যান বলেন, ‘সব সময় এটা ভাবার দরকার নেই যে, কেউ ইউটিউবে কিছু আপলোড করছে ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার জন্য। অনেকেই এখানে কেবল একটা ভিডিও রাখে শুধু সংরক্ষণ করার জন্য। ইউটিউব এক অর্থে এখন ইন্টারনেটের ভিডিও ক্লাউড।’

গবেষণায় উঠে এসেছে, ৭০ শতাংশের বেশি ইউটিউব ভিডিও ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অনেক ভিডিও দেখা যায় যেখানে ভিডিওগুলো বন্ধু বা পরিবারের জন্য বানানো—কোনো দর্শকদের জন্য নয়। গবেষকরা বলেন, এই ভিডিওগুলো ভাইরাল হলে বরং উল্টো সমস্যা হতো। কারণ, এগুলো ‘পাবলিকের’ উদ্দেশ্যে বানানোই হয়নি।

 গবেষকরা বলছেন, ইউটিউবের অ্যালগরিদম যেসব কনটেন্ট জনপ্রিয় করে তোলে, তার মধ্যে নেতিবাচকতা, ভুল তথ্য, রাজনৈতিক চরমপন্থা কিংবা ঘৃণাবাচক বক্তব্য থাকে বেশি। অথচ বাস্তবে প্ল্যাটফর্মের বেশিরভাগ কনটেন্ট হয় নিরপেক্ষ, নয়তো আশাব্যঞ্জক।

গবেষক ম্যাকগ্রাডি বলেন, ‘ইন্টারনেট অনেক সমস্যা তৈরি করছে। কিন্তু যখন আপনি বুঝবেন মানুষ আসলে কিভাবে এটি ব্যবহার করছে, তখন দেখতে পারবেন—এটা এখনো এক নির্ভেজাল প্রকাশ, সংযোগ আর মানবিকতার জগৎ।’

এই গল্পগুলো হয়তো কেউ দেখবে না। হয়তো ভিডিওগুলো ভাইরাল হবে না। কিন্তু এগুলোই বাস্তব ইউটিউব; ঝলমলে, স্পন্সরড, মনোযোগ-পিপাসু দুনিয়ার বাইরে মানুষের চুপচাপ কিছু মুহূর্ত।