জুলাই ২২, ২০২৫, ০৫:১৩ পিএম
রাজধানীর উত্তরায় সম্প্রতি একটি বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় এফ-৭ যুদ্ধবিমান আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। এই চীনা নির্মিত বিমানটি সোভিয়েত আমলের মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের আদলে তৈরি এবং এর পুরোনো প্রযুক্তি ও বারবার দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় এর নিরাপত্তা রেকর্ড নিয়ে বিশ্বজুড়ে গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। সামরিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আধুনিক যুদ্ধের জন্য এই বিমানটি প্রায় অনুপযোগী, যা এর ব্যবহারকারী দেশগুলোর জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন (সিএসি) দ্বারা নির্মিত এফ-৭ যুদ্ধবিমান মূলত চীনের চেংদু জে-৭ যুদ্ধবিমানের একটি উন্নত রপ্তানি সংস্করণ। ১৯৬৫ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই বিমান উৎপাদন করেছে সিএসি। ২০১৩ সালে চীন ১৬টি এফ-৭ বিমান বাংলাদেশে রপ্তানি করে, যা ছিল এই মডেলের শেষ চালান। এরপর থেকে চীন এফ-৭ বিমানের উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে।
এই বিমানটি একটি হালকা যুদ্ধবিমান, যা মূলত বহুমুখী অভিযান ও উন্নত প্রশিক্ষণে সক্ষম। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী বিশেষভাবে এই বিমান তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, মিয়ানমার, নামিবিয়া, নাইজেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, সুদান, তানজানিয়া এবং জিম্বাবুয়ের মতো কিছু দেশ এই বিমান ব্যবহার করছে। আধুনিক যুদ্ধবিমানের তুলনায় এর কম খরচ এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হওয়ায় তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি এখনো প্রচলিত।
তবে, সামরিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না চীনা এই বিমান। এতে উন্নত রাডার, ডেটা লিঙ্ক, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম কিংবা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মতো আধুনিক সক্ষমতা নেই। এটি মূলত 'পয়েন্ট ইন্টারসেপ্টর' হিসেবে কাজ করে, অর্থাৎ আকাশ প্রতিরক্ষা ও দ্রুত পাল্টা প্রতিক্রিয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বের কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এফ-৭ যুদ্ধবিমানকে 'নিষিদ্ধ' ঘোষণা করেনি, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বা গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে এর ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। তবে, বিশ্বের কিছু দেশ তাদের সামরিক বাহিনীর বহর থেকে এফ-৭ যুদ্ধবিমান সরিয়ে নিচ্ছে কিংবা নতুন বিমান দিয়ে প্রতিস্থাপন করছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্বব্যাপী এই বিমানের ব্যবহার কমে আসছে এবং এটি অপ্রচলিত হয়ে পড়ছে।
পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে চীনের তৈরি সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য ও তাদের মিত্র দেশগুলোতে চীনা সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো সাধারণত চীনা প্রযুক্তির ওপর আস্থা রাখে না। সাইবার নিরাপত্তা ও ইন্টেলিজেন্স ঝুঁকির কারণে তারা চীনা প্রযুক্তিকে এড়িয়ে চলে। পশ্চিমের পাশাপাশি চীনের প্রতিবেশী ভারত, ভিয়েতনাম কিংবা তাইওয়ানও কৌশলগত নীতির কারণে চীনা সামরিক সরঞ্জামের ব্যবহার করে না। তাই, এসব দেশে এফ-৭ যুদ্ধবিমান নিষিদ্ধ না হলেও বাস্তবে এর ব্যবহার নেই। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চীনা সামরিক যন্ত্রে সম্ভাব্য নজরদারি ও তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি রয়েছে।
বাংলাদেশে এফ-৭ যুদ্ধবিমানের দুর্ঘটনার রেকর্ড অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (বিএএফ) ২৭টি বিমান দুর্ঘটনার রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে কেবল গত দুই দশকে হওয়া ১১টি দুর্ঘটনার ৭টিই ছিল চীনের তৈরি বিমান।
সোমবার (২১ জুলাই, ২০২৫) ঢাকার উত্তরায় একটি এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বিমানটি দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পর বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় পাইলটসহ ৩১ জন নিহত ও ১৬৫ জন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বিমান বাহিনীর ওই বিমানে মাঝ-আকাশে প্রযুক্তিগত ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পাইলট ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে বিমানটিকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার রেকর্ড।
এছাড়াও বাংলাদেশে এফ-৭ যুদ্ধবিমানের আরও কয়েকটি দুর্ঘটনার রেকর্ড রয়েছে:
-
২৩ নভেম্বর, ২০১৮: টাঙ্গাইলের মধুপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে থাকা একটি চীনা এফ-৭ বিজি বিধ্বস্ত হয়। সেই সময় বিমানের পাইলট উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দীপু মারা যান।
-
২৯ জুন, ২০১৫: চীনা এফ-৭এমবি বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয়। সাগরে পড়ে যাওয়া ওই বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ নিখোঁজ হন।
-
৮ এপ্রিল, ২০০৮: টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে বিধ্বস্ত হয় একটি চীনা এফ-৭ যুদ্ধবিমান। বিমান থেকে বেরিয়ে আসার পরও স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান মারা যান।
এই ধারাবাহিক দুর্ঘটনাগুলো এফ-৭ যুদ্ধবিমানের নিরাপত্তা এবং আধুনিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এর কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে। বিশেষত, যেখানে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে বিমান যুদ্ধ সক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে পুরোনো প্রযুক্তির এই বিমানগুলোর ব্যবহার কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে সামরিক মহলে নতুন করে বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন: