সোমবার, ২৮ জুলাই, ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২

ভর্তুকি বন্ধে স্থবির হয়ে পড়েছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গতি

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ২৮, ২০২৫, ০১:০৩ পিএম

ভর্তুকি বন্ধে স্থবির হয়ে পড়েছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গতি

ছবি- সংগৃহীত

দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় কৃষিশ্রমিক বাড়ছে না, ফলে উৎপাদন মৌসুমে শ্রমিকসংকট প্রকট হয়ে উঠছে। এই শ্রম ঘাটতি মেটাতে সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে জোর দিয়েছিল। এ লক্ষ্যে ২০২০ সালে ৩ হাজার কোটি টাকার একটি ভর্তুকি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে বিগত সরকারই গত বছরের জুন থেকে প্রকল্পটিতে ভর্তুকি প্রদান স্থগিত করে। এর ফলে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গতি স্থবির হয়ে পড়েছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রি ৮০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।

কৃষিবিদেরা বলছেন, দেশ এখন বাণিজ্যিক কৃষির দিকে যাচ্ছে, তাই যান্ত্রিকীকরণ জরুরি। কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, "এখন শ্রমিকের মজুরি বেশি। সময়মতো শ্রমিকও পাওয়া যায় না। তাই যান্ত্রিকীকরণ উৎসাহিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে যন্ত্রের দাম বেশি, তাই ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্নীতি হলে ব্যবস্থা নিতে হবে।"

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটির আওতায় সরকার সমতল এলাকায় ৫০ শতাংশ এবং হাওরাঞ্চলে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়। এর ফলে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান চীন-ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, সিডার, পাওয়ার টিলারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি করছে। এর মধ্যে একেকটি কম্বাইন হারভেস্টারের দাম পড়ে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মতো। প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ১২ ধরনের মোট ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র দেওয়ার কথা রয়েছে।

দেশে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসায় নেতৃত্ব দিচ্ছে এসিআই, মেটাল, আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ, আবেদিন, বাংলা মার্কসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, আমদানি করা কৃষিযন্ত্রের বিক্রি ব্যাপকভাবে কমেছে।

দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই। সরকারের ভর্তুকি বন্ধ হওয়ার কারণে তাদের কৃষিযন্ত্র বিক্রি প্রায় ৯০ শতাংশ কমেছে। ফলে তাঁদের নতুন যন্ত্র আমদানি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে এসিআই অ্যাগ্রি বিজনেস বিভাগের প্রেসিডেন্ট এফ এইচ আনসারী প্রথম আলোকে বলেন, "গত বছর আমরা অনেক যন্ত্র আমদানি করেছি। কিন্তু ভর্তুকি বন্ধ হওয়ায় বিক্রি কমে গেছে। আগে আমদানি করা যেসব যন্ত্র আছে, সেগুলো দামের ২০-৩০ শতাংশ এককালীন জমা নিয়ে বিক্রি করছি।"

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে এখন গরু দিয়ে হাল চাষের বদলে ধানের জমি প্রস্তুত করতে প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ট্রাক্টর ব্যবহার করা হয়। তবে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা হয় মাত্র ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে। বাকিটা হাতে করা হয়।

দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে যুক্ত আরেক প্রতিষ্ঠান মেটালের সূত্রে জানা যায়, তাদের ব্যবসাও ব্যাপকভাবে কমেছে। প্রতিষ্ঠানটি আগে বছরে যেখানে ৫০০ থেকে ৭০০ কম্বাইন হারভেস্টার বিক্রি করত, সেখানে ভর্তুকি বন্ধের পর এখন তা ১০০ থেকে ১৫০টিতে নেমে এসেছে।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, "গত বছরের জুন থেকে ভর্তুকি বন্ধ রয়েছে। ভর্তুকি ছাড়া ৩২ লাখ টাকায় একটি মেশিন কেনা সম্ভব না। এখন আমরা বাধ্য হয়ে ৫-৭ লাখ টাকা নিয়ে ২০-২৫ লাখ টাকা বাকিতে মেশিন বিক্রি করে দিচ্ছি।"

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, দেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বাজারের আকার চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর প্রায় ৮-৯ হাজার ট্রাক্টর দেশে প্রবেশ করছে। একসময় ট্রাক্টর আমদানিতে সরকার ভর্তুকি দিত। তাই এটার বাজার প্রসারিত হয়েছে। একইভাবে আরও পাঁচ বছর যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি দিলে হারভেস্টারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারেও নতুন বাজার তৈরি হবে।

এদিকে গত জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের’ যন্ত্র বিতরণে অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০২০ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি এ বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

এ নিয়ে প্রকল্প পরিচালক মঞ্জুর-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, "নতুন কিছু যন্ত্রে ভর্তুকি বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৪০ হাজার যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। আরও ১১ হাজারের বেশি যন্ত্র বিতরণ করা হবে। আমাদের আরও ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। তাই প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হচ্ছে।"

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ভবিষ্যৎ নিয়ে কৃষিসচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, "প্রকল্পটিতে বেশ কিছু অনিয়ম হয়েছে। এগুলোর তদন্ত চলমান রয়েছে। এসব দূর করে আবার ভর্তুকি প্রদান শুরু হবে। কিছুটা সময় লাগতে পারে।"