জুলাই ২২, ২০২৫, ০৩:২৩ পিএম
২১ জুলাই, ২০২৫ তারিখে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর, যখন সবাই দিগ্বিদিক ছুটছিল, তখন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসংখ্য শিশুকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন এক মহীয়সী নারী— মাহরীন চৌধুরী। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই সমন্বয়ক নিজের দায়িত্বের জায়গা থেকে একচুলও নড়েননি। অগ্নিকাণ্ডের সময় নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষাই ছিল তার একমাত্র ব্রত। তার এই আত্মত্যাগ সারাদেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে।
বিমান বিধ্বস্তের পরপরই যখন স্কুলের একটি ভবনে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন মাহরীন চৌধুরী শিশুদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার ছোট ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী এক হৃদয়বিদারক ফেসবুক পোস্টে বোনের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, "মাহরীন আপু (মাহরীন চৌধুরী) আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি আমার বড় বোন, যিনি আমাকে মায়ের মতো করে বড় করেছেন। তিনি মাইলস্টোন স্কুলের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। ভবনে আগুন লাগার সময় তিনি সবার আগে নিজে বের হননি, বরং যতজন ছাত্রছাত্রীকে পারা যায়, বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। এতে তাঁর শরীরের ১০০ শতাংশ অংশ পুড়ে যায়।"
মুনাফ মজিব চৌধুরীর পোস্ট থেকে জানা যায়, মাহরীন চৌধুরী গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা গেছেন। তিনি রেখে গেছেন তার দুই ছেলে। এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাহরীন চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অসংখ্য পোস্ট চোখে পড়ছে। তার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা তাকে 'বীর' হিসেবে বর্ণনা করে আবেগঘন লেখালেখি করছেন।
এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ফেলিসিয়া ডরোথিয়া হেমানসের বিখ্যাত কবিতা 'ক্যাসাবিয়াঙ্কা'র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কবিতাটিতে একটি সাহসী ছেলের গল্প বলা হয়েছে, যে তার বাবার নির্দেশ মেনে জ্বলন্ত জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত পুড়ে মারা গিয়েছিল, কিন্তু নিজের স্থান ত্যাগ করেনি। কবিতার পংক্তিগুলো যেন মাহরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি:
"The boy stood on the burning deck Whence all but he had fled; The flame that lit the battle's wreck Shone round him o'er the dead."
"ছেলেটি জ্বলন্ত জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ছিল সরে গিয়েছিল সবাই—কেবল সে ছিল বাকি; সেই আগুনের আলো, ধ্বংসস্তূপের ওপরে পড়ে ছিল চারদিকে মৃতদেহ।"
কিন্তু মাহরীন চৌধুরী আরও বড় কাজ করেছেন। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ির এই শিক্ষক শুধু নিজের জায়গায় স্থির ছিলেন না, তিনি অসংখ্য শিশুকে, তার নিজের ছাত্রছাত্রীদের বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি যেন বাংলাদেশের বুকে এক নতুন 'ক্যাসাবিয়াঙ্কা' হয়ে অমরত্ব লাভ করলেন।
উত্তরা মাইলস্টোন কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ২৬ শিশুসহ মোট ২৭ জন নিহত হয়েছেন এবং শতাধিক মানুষ গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। এই গভীর শোকে সারাদেশ যখন স্তব্ধ, তখন মাহরীন চৌধুরীর মতো 'বীর' শিক্ষকদের আত্মত্যাগের গল্প মানুষকে সাহস জোগাচ্ছে এবং গভীর শ্রদ্ধায় নত করছে। তার এই আত্মত্যাগ প্রমাণ করে, মানবতা এবং আত্মোৎসর্গের চেতনা এখনো সমাজে বিদ্যমান। মাহরীন চৌধুরীকে আমরা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি এবং তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
আপনার মতামত লিখুন: