জুলাই ২২, ২০২৫, ০১:৫৭ পিএম
রাজধানীর উত্তরায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ভয়াবহ গুজবের জাল বিস্তার করেছে একটি অনলাইন জুয়াড়ি চক্র। 'অ্যানোনিমাস মেইন পেজ' নামক একটি ফেসবুক পেজ থেকে চালানো এই পরিকল্পিত অপপ্রচার বিমান বিধ্বস্তের মর্মান্তিক ঘটনাকে পুঁজি করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই পেজটি আন্তর্জাতিক হ্যাকিং গ্রুপ 'অ্যানোনিমাস'-এর কোনো অফিসিয়াল অংশ নয়, বরং এটি পরিচালিত হচ্ছে একটি সুসংগঠিত অনলাইন জুয়া চক্রের মাধ্যমে, যার মূল উদ্দেশ্য অনলাইন জুয়া প্রচার ও নতুন সদস্য সংগ্রহ।
গত সোমবার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারি ভবনের কাছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই 'অ্যানোনিমাস মেইন পেজ' থেকে ২০ জুলাইয়ের একটি পুরোনো স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়। ওই স্ট্যাটাসে দাবি করা হয়েছিল যে, একটি স্কুল বিল্ডিং ধসে পড়বে এবং এতে অনেক শিশুর প্রাণহানি ঘটবে, যার কারণ হবে দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ। বিমান দুর্ঘটনার পর পরই কিছু মানুষ এই স্ট্যাটাসকে চলমান ঘটনার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে দাবি করতে শুরু করে যে, এটি হয়তো বিমান দুর্ঘটনারই আগাম বার্তা। শুধু তাই নয়, ওই একই পেজ থেকে বিমান দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পর আরও একটি স্ট্যাটাসে দাবি করা হয়, তারা আগেই সতর্ক করেছিল এবং একদিন আগেই এমন কিছু ঘটার আগাম বার্তা দিয়েছিল। একের পর এক এমন মিথ্যা ও ভীতি সঞ্চারকারী পোস্ট দিয়ে পেজটি জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে।
সোমবার সন্ধ্যায় ওই একই পেজ থেকে আরও একটি চাঞ্চল্যকর স্ট্যাটাসে দাবি করা হয়— "বাংলাদেশে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি বোমা বিস্ফোরিত হবে, যা কোনো হোটেল কিংবা হাসপাতালে হতে পারে।" মুহূর্তে এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় এবং অসংখ্য মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পোস্টটি শেয়ার করতে শুরু করে।
এই গুজবের ভয়াবহতা বেশি দূর গড়ানোর আগেই আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেক বিষয়ক সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির তার ফেসবুক পোস্টে এই চক্রের মুখোশ উন্মোচন করেন। তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। শিশির তার পোস্টে উল্লেখ করেন, 'অ্যানোনিমাস মেইন পেজ' নামক পেজটি কোনোভাবেই 'অ্যানোনিমাস' হ্যাকার গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। অ্যানোনিমাসের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে যে ফেসবুক পেজ দেওয়া আছে, এটি তা নয়।
দ্বিতীয়ত, এই পেজটি একটি অনলাইন জুয়ার পেজ, যা মূলত অনলাইন জুয়া (টিকিট বিক্রির) প্রচার এবং নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত হয়। তারা নিয়মিত অনলাইন গেমিং বা জুয়া সংক্রান্ত পোস্ট দিয়ে থাকে।
তৃতীয়ত, 'স্কুল ভবন ধসে' পড়া সংক্রান্ত যে পোস্টটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে কোথাও বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। মূল পোস্টের বক্তব্য ছিল: "A school building will collapse leaving lots of kids l!veless. We see a terrible disaster fast coming, This will be as a result of poor maintenance on the building. We shall do everything in our power to avert this terrible catastrophe we’ve seen coming." এই ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের বিমান দুর্ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই, কারণ বাংলাদেশে স্কুল ভবন ধসে পড়েনি, বরং ভবনের ওপর বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। নিহতরা ভবনের দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণের কারণে নয়, বরং বিমান বিস্ফোরিত হয়ে লাগা আগুনে প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে, এই পোস্টকে বাংলাদেশের ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে দাবি করার কোনো সুযোগ নেই।
চতুর্থত, এই পেজটি যে একটি স্ক্যামার জুয়াড়ি গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত, তা তাদের সাম্প্রতিক কার্যক্রম থেকেই স্পষ্ট। পোস্ট ভাইরাল হওয়ার প্রথম দিকে পেজটির ট্রান্সপারেন্সি সেকশনে দেখা যায় এটি তিনটি দেশ থেকে চালানো হয়, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র (হাওয়াই দ্বীপ) ও নাইজেরিয়া রয়েছে। তৃতীয় দেশটির নাম অ্যাডমিন প্রকাশ করেনি। তবে পোস্ট ভাইরাল হওয়ার পর তাদের পেজের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় অ্যাডমিনরা অবস্থানকারী দেশের তথ্য গোপন করে দিয়েছে। আফ্রিকান দেশ নাইজেরিয়া অনলাইন জুয়াড়িদের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত। তাদের পুরোনো প্রমোশনাল ভিডিওতে একজন আফ্রিকানকেও দেখা গেছে, যা নাইজেরিয়ান জুয়াড়িদের যোগসূত্রের সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করে।
এই জুয়াড়ি চক্রটি যখন বুঝতে পারে যে তাদের পোস্ট বাংলাদেশে ভাইরাল হওয়ার পর তারা ব্যাপক মনোযোগ পাচ্ছে (তাদের ফলোয়ার ২ লাখের কাছাকাছি থেকে ৩ লাখের ওপরে উঠেছে), তখন তারা বাংলাদেশের বিষয়বস্তু নিয়ে একের পর এক পোস্ট দেওয়া শুরু করে। তারা এমনকি 'ভবিষ্যদ্বাণী' করে যে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের মার্কেটগুলোতে 'ভয়ঙ্কর কিছু' ঘটবে। একই সঙ্গে, তারা বাংলাদেশি নতুন ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে তাদের অন্যান্য জুয়ার পেজ প্রমোট করা শুরু করেছে এবং দ্রুত ফলোয়ার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে এমনিতেই ক্রমবর্ধমান অনলাইন জুয়ার প্রবণতা আরও বেড়ে অসংখ্য মানুষকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
এই ধরনের গুজব কেবল জনমনে আতঙ্কই ছড়ায় না, বরং দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী গুজব ছড়ানো একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই ধরনের অনলাইন জুয়াড়ি চক্র ও গুজব সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা। একই সঙ্গে, সাধারণ জনগণের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে তারা গুজবের ফাঁদে পা না দেন এবং যেকোনো তথ্য যাচাই না করে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকেন। অনলাইন প্লাটফর্মগুলোরও এই ধরনের গুজব ও প্রতারণামূলক কার্যক্রম বন্ধে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত।
আপনার মতামত লিখুন: