জুলাই ২২, ২০২৫, ০৩:৪৮ পিএম
রাজধানীর উত্তরায় প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে দু’জন শিক্ষকের নাম উঠে এসেছে, যা শোকাহত জাতিকে নতুন করে নাড়া দিয়েছে। মর্গের ডেথ রেজিস্ট্রার থেকে প্রাপ্ত এই তথ্য মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এবং এর পেছনে থাকা মানবিক বিপর্যয়কে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। যদিও দুর্ঘটনার পর প্রাথমিক ব্রিফিংয়ে একজন শিক্ষকের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছিল, গভীর অনুসন্ধানে জানা গেছে আত্মত্যাগের এ তালিকায় রয়েছেন দু’জন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের মর্গের ডেথ রেজিস্ট্রারে যে দুই শিক্ষকের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন মাহেরীন চৌধুরী এবং মাসুকা বেগম। সোমবার রাত ৮টা ৫০ মিনিটে মাহেরীন চৌধুরী এবং রাত ১২টা ২০ মিনিটে মাসুকা বেগম মারা গেছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এই তথ্যটি প্রাথমিক তথ্যের চেয়ে ভিন্ন হওয়ায় আমাদের অনুসন্ধানী দল বার্ন ইনস্টিটিউটের একাধিক সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে। মঙ্গলবার সকালে মাসুকা বেগমের পরিবারের সদস্যরা তার লাশ বুঝে নেন। এ সময় তার খালাতো ভাই খালেকুজ্জামান সবুজ জানান, ৩৭ বছর বয়সী মাসুকা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় যে শিক্ষকটির বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে, তিনি হলেন মাহেরীন চৌধুরী। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রাতেই ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। জানা গেছে, এদিন দুপুরে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারি সেকশনের একটি ভবনে যখন প্রশিক্ষণ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, তখন সেখানে ক্লাস চলছিল এবং বহু শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর যখন আগুন ও ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে যায়, তখন শিক্ষক মাহেরীন নিজের জীবন বাজি রেখে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে শুরু করেন। তিনি দ্রুততার সঙ্গে আতঙ্কিত শিশুদের ভবন থেকে বের করে আনেন। আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, তার সাহসিকতাপূর্ণ প্রচেষ্টায় অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী অক্ষত বা সামান্য আহত অবস্থায় ভবন থেকে বের হতে সক্ষম হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই বীরত্বপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজে আটকা পড়েন এবং গুরুতর দগ্ধ হন। এই প্রসঙ্গে উদ্ধার অভিযানে থাকা একজন সদস্য বলেছেন, "আমরা যখন ভেতরে প্রবেশ করি, তখন দেখি ম্যাডাম একাংশেই দগ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন, তবে তার আশেপাশে অনেক শিশু অক্ষত ছিল।" এই ঘটনাটি শিক্ষকদের আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছে।
একজন অভিভাবক আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, "ম্যাডাম অনেক ভালো ছিলেন। সেনাবাহিনী আমাদের বলেছে, ওই ম্যাডামের জন্য অন্তত ২০ শিক্ষার্থী বেঁচে গেছে।" মাহেরীন চৌধুরীর স্বামী মনসুর হেলাল জানান, মাহেরীনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীরই ঝলসে গিয়েছিল। চিকিৎসকরা ৮০ ভাগ দগ্ধের কথা বললেও তার মনে হয়েছিল তিনি শতভাগ দগ্ধ হয়েছেন। তাকে বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (ICU) নেওয়ার আগেও তিনি স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন, যা তার অদম্য মনোবলের পরিচয়।
আপনার মতামত লিখুন: