জুলাই ৩১, ২০২৫, ১০:২১ এএম
রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলেও, এর বাস্তবায়ন নিয়ে বড় দলগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ছিল সরকার গঠনের পর দুই বছরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন হবে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, নির্বাচনের আগেই সংস্কারের আইনি ভিত্তি জরুরি, অন্যথায় তারা সংস্কার প্রস্তাবে স্বাক্ষর করবে না।
গতকাল বুধবার (৩০ জুলাই, ২০২৫) বিকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ জানান, বৃহস্পতিবার (আজ) গ্রহণযোগ্য খসড়া সনদ সব দলের কাছে তুলে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, সংসদে নারী আসনসহ ১৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে এবং আজকের মধ্যে বাকিগুলোয় ঐকমত্যে পৌঁছানোর আশা করছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষ পর্যায়ে এসেছে। বুধবার ছিল আলোচনার ২২তম দিন। এদিন আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল:
-
সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব
-
সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান
-
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব (অনুচ্ছেদ ৪৮(৩))
-
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ
-
সংসদের উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার
-
নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ
-
রাষ্ট্রের মূলনীতি
অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, "প্রাথমিক পর্যায়ে সব দল মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের নীতিগত অবস্থানে একমত হয়েছে। তবে সংবিধানে এ বিষয়ে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা নিয়ে কিছু ভিন্নমত রয়ে গেছে। এ প্রক্রিয়ায় বিএনপির দেওয়া সুপারিশ ও আপত্তিগুলো স্পষ্টভাবে কমিশনের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। আলোচনা এগিয়ে নিতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।" তিনি আরও জানান, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রস্তাব এখনো প্রস্তুত হয়নি, কিন্তু অন্য বিষয়গুলোয় দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আলোচনা চলছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এই সনদ আসলে একটি ঐতিহাসিক অঙ্গীকারনামা, যা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে জাতিকে একটি নতুন দিশা দেখাবে। তিনি উল্লেখ করেন, "আমরা একমত হয়েছি যে, সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে সব অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হবে। আর এর আগেই অনেক সংস্কার প্রস্তাব ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে কার্যকর হয়ে যাচ্ছে।" তিনি আরও জানান, এই সনদের চূড়ান্ত কপি প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরসহ কমিশনের সব সদস্য এবং রাজনৈতিক নেতাদের স্বাক্ষরে প্রকাশিত হবে এবং এটি জাতির সামনে উন্মুক্ত থাকবে। তার মতে, ৬টি সংস্কার কমিশনের ৮২৬টি সংস্কারের সুপারিশের মধ্যে ৬৫৯টিতে বিএনপি একমত পোষণ করেছে, মাত্র ৫১টিতে দ্বিমত পোষণ করেনি এবং ১১৬টিতে দ্বিমত পোষণ করেছে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সংস্কারের প্রস্তাবগুলোর আইনগত ভিত্তি না থাকলে তা বাস্তবায়নযোগ্য হবে না এবং জনগণের কাছে এর কোনো মূল্য থাকবে না। সেক্ষেত্রে জামায়াত সনদে সই করবে না। তিনি মঙ্গলবার কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো খসড়া সনদে 'দুই বছরের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন' এর কথা উল্লেখ থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন এবং সরকারের মেয়াদ বা কমিশনের এখতিয়ার সম্পর্কিত কোনো সময়সীমা নির্ধারণ না হওয়ায় উদ্বেগ জানান। ডা. তাহেরের আশঙ্কা, এটি কেবল পরামর্শ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং আইনি ভিত্তি না থাকলে তা শুধু একটি কথার কথা হয়ে যাবে। তিনি আইনজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করে সংস্কার প্রস্তাবকে আইনগত ভিত্তি দেওয়ার সুযোগ তৈরির প্রস্তাব করেন।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, "৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে।" তিনি জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদকে আলাদা বিষয় উল্লেখ করে জানান, সনদের মাধ্যমে রাষ্ট্র কাঠামোর বিষয়গুলো সন্নিবেশিত হবে, আর ঘোষণাপত্রে জুলাই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ। এনসিপি 'দুই বছরের প্রস্তাব' নাকচ করছে এবং আইনি ভিত্তি না পেলে সনদে সই করবে না বলে জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও আইয়ুব মিয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে মঙ্গলবারের আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপিসহ ৩০টির রাজনৈতিক দল অংশ নেয়, যার মধ্যে গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি অন্যতম।
আপনার মতামত লিখুন: