বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৫, ৩০ শ্রাবণ ১৪৩২

নিম্নমানের ড্রিলিং কোম্পানির খেসারত গুনছে বাপেক্স

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

আগস্ট ১২, ২০২৫, ১২:০৬ পিএম

নিম্নমানের ড্রিলিং কোম্পানির খেসারত গুনছে বাপেক্স

ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস অনুসন্ধান সংস্থা বাপেক্স বর্তমানে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক আর্থিক দণ্ডের মুখোমুখি হয়েছে। সম্প্রতি সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার (এসআইএকিউ) আজারবাইজানভিত্তিক ড্রিলিং কোম্পানি সোকার একিউএস এলএলসির পক্ষে রায় দিয়ে বাপেক্সকে প্রায় ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে। যদিও সোকারের দাবি ছিল প্রায় ৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সার্বিকভাবে আইনগত ব্যয় নির্বাহ, সেমুতাং সাউথ-১-এর মতো ড্রাই কূপের বিপরীতে খনন ব্যয়, ক্ষতিপূরণ দাবিসহ সব মিলিয়ে বাপেক্সের ১টি কূপের বিপরীতে ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৫৭ মিলিয়ন ডলার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রায় দেশের জ্বালানি খাতে চরম অদক্ষতা, দুর্বল নীতিমালা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা, কোম্পানির অভিজ্ঞতা যাচাই ও প্রযুক্তিগত মানের দিকে নজর না দিয়ে শুধু কম মূল্যের ভিত্তিতে দুর্বল চুক্তি ব্যবস্থাপনায় কাজ দেওয়ার মানসিকতার কারণেই আজ এই পরিস্থিতি।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. ফজলুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, "সোকারের বিষয়ে আমরা আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছি।" তিনি বলেন, "নিম্নমানের কোনো ড্রিলিং কোম্পানি যাতে কাজ না পায় সেজন্য আমরা যাচাই-বাছাই করি। এখন সবকিছু হচ্ছে দরপত্রের মাধ্যমে। এই কারণে নিম্নমানের কোম্পানির কাজ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি এসব দেখভাল করার জন্য মন্ত্রণালয়েরও একটি কমিটি রয়েছে।"

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সিলেট-১০ নম্বর কূপেও একই ধরনের একটি ব্যর্থতা ঘটেছিল। চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোপ্যাক ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কূপ খননের দায়িত্ব নিলেও তারা নির্ধারিত ৩ হাজার ৩০০ মিটার গভীরতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। মাত্র ২ হাজার ৫৭৬ মিটার গভীরে ড্রিল করার পর তথাকথিত উচ্চচাপের কারণে ড্রিল পাইপ আটকে যায়। ফলে বিশাল পরিমাণ গ্যাসের মজুদ থাকা সত্ত্বেও উত্তোলন সম্ভব হয়নি। এতে করে গ্যাস এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ—উভয়ই অপচয়ের শিকার হয়। সেসময় ওই কূপের নির্ধারিত গভীরতায় ড্রিলিংয়ে ব্যর্থ হলেও অজানা কারণে সিনোপ্যাককে সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করতে সিলেট গ্যাস ফিল্ডকে বাধ্য করা হয়, যার ফলে একই স্থানে ও প্যাডে আগের গ্যাস জোনে যাওয়ার জন্য নতুন আরেকটি কূপ ‘১০-এক্স’ খননের দায়িত্ব আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান সিসিডিসিকে দেওয়া হয়। সেখানেও রাষ্ট্রের অতিরিক্ত ২০০ কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। অথচ আগের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে একই ধরনের পরিকল্পনায় অনভিজ্ঞদের বারবার কাজ দেওয়ার ফলে গ্যাস খাতে নতুন বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।

সাম্প্রতিক তথ্যে জানা গেছে, প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের আগে একই সিনোপ্যাককে ভোলায় আরও পাঁচটি কূপ খননের জন্য মনোনীত করা হচ্ছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোলার ভূগর্ভস্থ চাপ সিলেটের চেয়েও বেশি, যা অনভিজ্ঞ কোম্পানির জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে একই মানহীন ড্রিলিং টিম ও রিগ দিয়ে কূপ খননের সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক ও আত্মঘাতী। ফলে বিশেষজ্ঞরা দেশের অন্যতম গ্যাস মজুদের ভরসা ভোলায় গ্যাসের রিজার্ভগুলো নষ্ট হবার ঝুঁকির কথা বলছেন।

 

দেশে শেভরন, হ্যালিবার্টন, স্লামবার্জার, তাল্লো, ইউনিকলের মতো অভিজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক মানের তেল-গ্যাস প্রতিষ্ঠানগুলোর সফল কর্মপরিকল্পনার প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস রয়েছে। তার পরেও জ্বালানি খাতের কিছু অসৎ ব্যক্তির স্বার্থে কম মূল্যের দরদাতা নির্বাচনের মাধ্যমে নিম্নমানের অনভিজ্ঞ কোম্পানিগুলোর হাতে এসব কাজ তুলে দেওয়া হচ্ছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাস উত্তোলন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ হাজার ৭৬৭ মিলিয়ন ঘনফুটে, যা আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০টি নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা ঘোষণা করলেও তহবিল সংকটে তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে ৮টি ওয়ার্কওভারসহ মোট ১৮টি কূপ খনন কাজ মাত্র সম্পাদিত হয়েছে। এটি ৬২৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে জাতীয় গ্যাস বিপণন ব্যবস্থায় আশাব্যঞ্জক নয়।

এরই মধ্যে ভোলায় পাইপলাইন স্থাপন বা এলএনজি/সিএনজি বিকল্প ব্যবস্থাপনায় গ্যাস স্থানান্তরের কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই আগের সরকারের ভুল নীতিতে নতুন ৫টি কূপ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকায় ড্রিলিংয়ে ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাপেক্স কর্মকর্তাদের মতে, বাপেক্সের জন্য ৫৭৭ কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে আগামীতে ভোলায় ধীরে ধীরে কূপ খনন কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেত।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মত, জিটিসিএলের মাধ্যমে ভোলা-বরিশাল-ঢাকা-খুলনা পাইপলাইন স্থাপন ও গ্যাস গ্রিডে সংযোগ দ্রুত নিশ্চিত করা; তারপর ভোলায় প্রস্তাবিত ১৯টি নতুন কূপ পর্যায়ক্রমে খননের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ভোলায় এখন ৯টি কূপের উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট থাকলেও সর্বোচ্চ ৭০-৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে শুধু পাইপলাইন না থাকার কারণে। এ অবস্থায় ৯০-১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহারের গ্রাহক নিশ্চিত না করে নতুন কূপ খনন হলে বাপেক্সের ওপর আর্থিক ঋণের বোঝা চাপবে। বিশ্লেষকদের মতে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জ্বালানি খাতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি এখনো পেট্রোবাংলার গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছেন।