বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৫, ৩০ শ্রাবণ ১৪৩২

যমুনা সেতুর রেললাইন সরছে, যানজট কমাতে ১১ ফুট চওড়া হবে সড়ক

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

আগস্ট ১২, ২০২৫, ০১:৩৫ পিএম

যমুনা সেতুর রেললাইন সরছে, যানজট কমাতে ১১ ফুট চওড়া হবে সড়ক

ছবি- সংগৃহীত

যমুনা নদীর ওপর নতুন রেলসেতু চালু হওয়ায় এখন যমুনা সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু) দিয়ে আর ট্রেন চলাচল করছে না। তাই রেল কর্তৃপক্ষ সেতুর ওপর থেকে রেললাইন উঠিয়ে নিচ্ছে। এই অপসারণ প্রক্রিয়ার ফলে যমুনা সেতুতে প্রায় সাড়ে ১১ ফুট চওড়া বাড়তি জায়গা তৈরি হবে, যা যান চলাচলের পথে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে সেতু বিভাগ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপনকারী যমুনা সেতু দিয়ে যাতায়াতকারীদের যাত্রা আরও সহজ ও স্বস্তির হবে।

সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস বলেন, বিশেষজ্ঞদের নকশা ও মতামত পাওয়ার পরই সড়ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু হবে। তিনি আশা করছেন, ছয় মাসের মধ্যেই কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।

যমুনা সেতুর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ সরকারের সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, রেলপথের জন্য ব্যবহৃত জায়গায় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য বাড়তি কিছু কাজ করতে হবে, এতে অর্থ ব্যয়ও হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এতে পুরোপুরি সায় দিয়েছে। এখন কীভাবে সড়ক সম্প্রসারণ করা হবে, এর নকশা প্রণয়ন ও ব্যয় নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয়েছে। তবে এবার বিদেশি নয়, সব দেশি বিশেষজ্ঞ এই কাজ করছেন। এই কাজে দেশের ছয়টি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত করা হয়েছে।

যমুনা নদীর ওপর নতুন করে নির্মিত রেলসেতু (যমুনা রেলসেতু) গত ফেব্রুয়ারিতে চালু করা হয়। এরপর যমুনা সেতুতে থাকা রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বাংলাদেশের দীর্ঘতম এই রেলসেতুর দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার, যা আসা-যাওয়ার দুটি লাইন (ডুয়েল গেজ, ডাবল ট্র্যাক) নিয়ে গঠিত। রেলসেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশ সরকার ও জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে নির্মিত।

১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর সড়কসেতু চালু হয়। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, শুরুতে যমুনা সেতুতে রেল চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যমুনা সেতুতে রেললাইন যুক্ত করার নির্দেশ দেন। নকশায় পরিবর্তন এনে যমুনা সেতুর এক পাশে রেলপথ স্থাপন করা হয়, এতে যান চলাচলের পথ কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে। ২০০৬ সালে সেতুতে ফাটল দেখা দেওয়ার পর ট্রেনের গতি কমানো হয় এবং ভারী মালবাহী ট্রেনের চলাচল বন্ধ করা হয়। উত্তরের পথে যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল সহজ করতে ২০১৬ সালে যমুনা নদীর ওপর নতুন রেলসেতু নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়।

যমুনা সেতু চার লেনের হলেও, সেতুর যান চলাচলের পথ আন্তর্জাতিক মানের নয় এবং পদ্মা সেতুসহ দেশের নতুন অন্যান্য সেতুর চেয়েও অনেক কম চওড়া। ফলে সপ্তাহের শেষ কিংবা শুরুর দিন ছাড়াও ঈদসহ নানা উৎসবের সময় যমুনা সেতুর দুই পাশে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। বর্তমানে যমুনা সেতু দিয়ে দৈনিক গড়ে ২২ হাজার যানবাহন চলাচল করে। গত ঈদুল আজহার সময় এক দিনে এই সেতু দিয়ে ৬৪ হাজারের বেশি যানবাহন পারাপারের রেকর্ড তৈরি হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদর্শ মানদণ্ড অনুসারে, চার লেনের সেতু বা সড়কের মাঝখানে থাকে বিভাজক। এর প্রতিটি অংশের প্রস্থ কমপক্ষে ২৪ ফুট হতে হয়। কিন্তু যমুনা সেতুর যান চলাচলের পথের বর্তমান প্রস্থ ৪১ ফুটের কিছু বেশি, অর্থাৎ আসা-যাওয়ার প্রতিটি পথ চওড়ায় ২০ ফুটের কিছু বেশি। সেতু থেকে রেলপথ উঠে যাওয়ার পর বাড়তি সাড়ে ১১ ফুট জায়গা বের হবে। এতে সেতুর মাঝখানের বিভাজক কিছুটা সরিয়ে দুই পাশে পৌনে ছয় ফুট করে যান চলাচলের বাড়তি পথ তৈরি করা সম্ভব।

অন্যদিকে যমুনা সেতুর আগে-পরে যে চার লেনের মহাসড়ক রয়েছে, তার প্রতিটি পাশ ২৪ ফুট করে চওড়া। ফলে অনায়াসে দুটি যানবাহন একসঙ্গে চলার পরও জায়গা ফাঁকা থাকে। কিন্তু যমুনা সেতু দিয়ে দুটি যান একসঙ্গে চলতে কষ্ট হয়। সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সেতুর কর্মীদের যাতায়াতের জন্য সেতুতে হাঁটার কোনো জায়গাও নেই। ফলে দুই দিক থেকে চওড়া মহাসড়ক ধরে যানবাহন এসে সেতুর গোড়ায় আটকে যায়, কারণ মহাসড়কের চেয়ে সেতু কম চওড়া। এর বাইরে টোল প্লাজায় যানবাহনের গতি কিছুটা ধীর হয়।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়) শেখ মইনউদ্দিনবলেন, "যমুনা সেতুর সড়কপথ সম্প্রসারিত হলে দুই পাড়ের চওড়া মহাসড়কের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। এতে যমুনা সেতু দিয়ে যাতায়াত আরও সহজ হবে। সেতুর দুই প্রান্তে যানজট আরও কমবে।"

সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতুতে এ সমস্যা নেই। এ সেতুর আসা-যাওয়ার দুই দিকের পথ ৩১ ফুটের চেয়ে বেশি চওড়া। সেতুর আসা-যাওয়ার পথের পাশে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা আছে, যেখান দিয়ে অনায়াসে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা যায়। বর্তমানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোতে যত সেতু আছে বা নির্মিত হচ্ছে, তার সব কটিরই মাঝখানে বিভাজক আছে। বিভাজকের প্রতি পাশে আসা-যাওয়ার জন্য সর্বনিম্ন ২৬ ফুট চওড়া পথ রয়েছে। এর চেয়ে বেশি চওড়া পথও আছে।

গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সিরাজগঞ্জ প্রান্ত থেকে যমুনা সেতুর রেললাইন খুলে ফেলার কাজ শুরু হয়। প্রথমে খোলা হয় নাট-বল্টু। এখন রেললাইন তোলার কাজ চলছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে রেললাইন অপসারণের কাজ সম্পন্ন হতে পারে বলে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে।

গত মাসে যমুনা সেতুর যান চলাচলের পথ সম্প্রসারণ ও রেললাইন অপসারণের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়) শেখ মইনউদ্দিন। তিনি দ্রুত রেলপথ অপসারণের নির্দেশনা দেন।

রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আহম্মদ হোসেন মাসুম বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর এই পরিদর্শনকালে সেতু বিভাগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে যমুনা সেতুর সড়ক সম্প্রসারণের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। তাঁরা আগামী তিন মাসের মধ্যে রেললাইন অপসারণ করতে পারবেন। এর মধ্যে সেতু বিভাগের অন্যান্য প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়ে যাবে।

সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বছর দুয়েক আগে যমুনা সেতুর রেলপথের জায়গায় সড়কপথ সম্প্রসারণ বিষয়ে সরকারের মতামত চেয়েছিল সেতু বিভাগ। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যমুনা সেতুতে রেলপথ যুক্ত করেছিলেন বলে তিনি তা সরিয়ে ফেলার পক্ষে ছিলেন না। এ জন্য সেতু বিভাগ আর এগোয়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেতু বিভাগ থেকে আবার প্রস্তাব দিলে তা অনুমোদন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এরপরই চলতি বছরের শুরুতে নকশা প্রণয়নের লক্ষ্যে পরামর্শক নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়।