জুলাই ২৪, ২০২৫, ১০:৫৪ এএম
ভারতের রাজধানী দিল্লি সংলগ্ন গুরুগ্রাম (গুরুগাঁও) অঞ্চলে 'বাংলাদেশি' সন্দেহে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃক বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের আটক করে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। এমন একটি ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বাসিন্দা পাথর আলি শেখের সঙ্গে, যিনি গুরুগ্রামে ভাঙ্গারির কাজ করেন।
গত শনিবার (১৯শে জুলাই) পাথর আলি শেখ রাজধানী দিল্লির লাগোয়া গুরুগ্রামের রাস্তায় কাগজ-ভাঙা বোতল কুড়োচ্ছিলেন। হঠাৎই একটি পুলিশের গাড়ি তাকে ডেকে কাগজপত্র দেখতে চায়। মি. শেখের দাবি, তিনি কাজের সময় মূল্যবান কাগজপত্র বা ফোন সঙ্গে রাখেন না। কাগজপত্র দেখাতে না পারায় পুলিশ তাকে গাড়িতে তুলে সেক্টর ৪৩ থানায় নিয়ে যায়।
মি. শেখ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "সেখানে আমার মতো ১০ জনকে এনেছিল। আমাদের বলল পরিচয় যাচাই করা হবে আমাদের দেশ-বাড়ি যে থানায়, সেখান থেকে। সব নাম ঠিকানা নিয়ে রাতে আবার চালান করে দিল সেক্টর ১০এ-তে। একটা কমিউনিটি হলে রাখা হলো। সেখানে প্রচুর মানুষ – সবাইকে একইভাবে ধরে এনেছে।"
পাথর আলি শেখের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই অস্থায়ী শিবিরে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের বহু বাঙালি মানুষ ছিলেন। তিনি জানান, "আমরা মোট ৭৪ জন ছিলাম। দুই বেলা ভাত তরকারি খেতে দিত।" তার বাড়ি নদীয়া জেলার নবদ্বীপ থানার ওসি মি. শেখের সব পরিচয়পত্র যাচাই করে একটি চিঠি গুরুগ্রাম পুলিশের কাছে পাঠানোর পরে বুধবার দিবাগত রাত একটা নাগাদ পাথর আলি শেখ ছাড়া পান।
তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, "আমি তো ভারতীয়। সব কাগজ তো দেখিয়েছিলাম। তবুও আমাকে চারদিন আটকিয়ে রাখল!" তার সঙ্গে মোট ২৬ জনকে ছাড়া হয়েছে, তবে এখনো কয়েকজন সেখানে আটক আছেন বলে বুধবার দুপুরে জানিয়েছেন পাথর আলি শেখ।
গুরুগ্রামের এক শ্রমিক সংগঠক মুকুল হাসান শেখ জানিয়েছেন, বহু বাংলাভাষীকেই এভাবে পুলিশ আটক করছে। তিনি বলেন, "আমি গুরুগ্রামের আট-দশটা সেক্টরে ঘুরে দেখছি আসাম আর পশ্চিমবঙ্গের বহু বাঙালি মানুষদের ধরা হচ্ছে। কাজের জায়গা থেকে তুলে আনছে অনেককে। কোনো কথাবার্তা কিছু নেই, তুলে নিয়ে যাচ্ছে নাকি ভেরিফিকেশন করবে!"
মুকুল হাসান শেখ আরও অভিযোগ করেন, "এর মধ্যে আবার মুসলমানদের বেছে বেছে আটক করছে। একই জেলার বাসিন্দা হিন্দু পদবী শুনে তার আধার কার্ড দেখে ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু মুসলমান হলেই তাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকে ওই কমিউনিটি হলে আটকিয়ে রাখছে। আবার আসামের মানুষরা যখন এনআরসি-র নথি দেখাচ্ছে, সেগুলোকেও জাল নথি বলছে পুলিশ।"
বিবিসি বাংলা এর আগে প্রতিবেদন করেছিল যে গুরুগ্রামে অন্তত ছয়জন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাকে 'বাংলাদেশি' সন্দেহ করে আটক করে শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলে তাদের পরিবার অভিযোগ করেছে। মুকুল হাসান শেখ বলছিলেন, বহু মানুষকে এভাবে আটক করায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে গুরুগ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুপান্থ সিনহা যিনি পাথর আলি শেখকে আটকিয়ে রাখা হয়েছিল সেই গুরুগ্রামের সেক্টর ১০এ-র কমিউনিটি হলে অস্থায়ী আটক শিবিরে দিন কয়েক আগে প্রায় দুশোজনকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "খুবই অমানবিক, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তিন-চারদিন ধরে আটক রাখা হয়েছে এদের। পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হচ্ছে না।"
মি. সিনহা জানান, পরিচয়পত্রের নথি যাচাইয়ের জন্য এভাবে কাউকে আটকিয়ে রাখা বেআইনি। তিনি বলেন, পুলিশ নাকি মৌখিকভাবে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কোনো নির্দেশ আছে যে কাউকে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ হলে তাকে ৩০ দিন পর্যন্ত আটক করে রাখা যাবে। তবে তিনি বলেন, এরকম নির্দেশ যদি সত্যিই দেওয়া হয়ে থাকে, তা যেমন বেআইনি, তেমনই সংবিধানের লঙ্ঘনও।
অন্যদিকে, গুরুগ্রাম পুলিশের জনসংযোগ অফিসার সন্দীপ তুরান বলেছেন, "ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ হওয়ার পরেও কাউকে আটক করে রাখা হয়েছে, এরকম তথ্য আমার কাছে নেই। যদি আপনাদের কাছে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য থাকে যে পরিচয়পত্র যাচাই করে ভারতের নাগরিকত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তবু আটকে রাখা হয়েছে, তাহলে আমাদের জানান।"
ভারতের রাজস্থান, গুজরাত, ছত্তিশগড়, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও ওড়িশাতেও অবৈধ বাংলাদেশি চিহ্নিত করতে গিয়ে ভারতের বাংলাভাষীদের আটক করার ঘটনা ঘটছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলমান, তবে হিন্দুদেরও আটক করা হচ্ছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও তাকে বাংলাদেশে 'পুশ আউট' করে দেওয়ার ঘটনাও সামনে এসেছে। এই পরিস্থিতি ভারতে বসবাসরত বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।
আপনার মতামত লিখুন: