জুলাই ২৬, ২০২৫, ০৯:৫১ এএম
ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই অভিযোগ নতুন মাত্রা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনের মাধ্যমে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোনো সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ছাড়াই শয়ে শয়ে বাংলাভাষী মুসলমানকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিচ্ছে, যাদের অনেকেই ভারতের নাগরিক। এই ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির ক্ষেত্রে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এক বিস্তারিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারত সরকার ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে শয়ে শয়ে বাংলাভাষী মুসলমানকে বেআইনিভাবে বাংলাদেশে বিতাড়িত করছে। এই বিতাড়িতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় নাগরিকও রয়েছেন। এইচআরডব্লিউ-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ মে থেকে ১৫ জুনের মধ্যে ভারত ১৫০০-এর বেশি মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১০০ জন মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীও রয়েছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই সংখ্যা প্রকাশ করেছে। তবে ভারত সরকার এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেছেন, "ভারতীয় নাগরিক সহ বাঙালি মুসলমানদের দেশ থেকে যথেচ্ছভাবে বিতাড়িত করে দিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বৈষম্য তৈরি করছে।"
প্রতিবেদনটি তৈরিতে জুন মাসে ১৮ জন ভুক্তভোগীর সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, এবং আরও ৯ জন ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারগুলোতে উঠে এসেছে, কিভাবে ভারতীয় নাগরিক হয়েও অনেকে বাংলাদেশে বিতাড়িত হয়েছেন, আবার কেউ কেউ বাংলাদেশে যাওয়ার পর ভারতে ফিরে এসে আটক হয়ে নিখোঁজ রয়েছেন। বিবিসি বাংলাও পূর্বে এমন অনেক ঘটনার সংবাদ সম্প্রচার করেছে।
এইচআরডব্লিউ বারবার উল্লেখ করেছে যে ভারত থেকে বিতাড়িতদের একটি বড় অংশই আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক এবং তারা বাংলাভাষী মুসলমান। সংস্থাটি জানিয়েছে, আসাম, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িশা এবং রাজস্থানের বিজেপি শাসিত সরকারগুলো মূলত গরিব ও পরিযায়ী মুসলমানদের আটক করছে। আটক করার পর তাদের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
কিছু ক্ষেত্রে বিএসএফ আটক ব্যক্তিদের মারধর করেছে এবং যথাযথভাবে তাদের নাগরিকত্ব যাচাই না করেই জোর করে বাংলাদেশ সীমান্ত পার করতে বাধ্য করছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সীমান্ত পার করে দেওয়ার পরে নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম এমন ডজনখানেক মানুষকে ভারত পুনরায় ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে এপ্রিল মাসে "হিন্দু পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা" হওয়ার পর থেকেই এই বিতাড়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই হামলার পর পুলিশ মুসলমানদের হেনস্থা করা শুরু করে এবং ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ অগ্রাহ্য করে তাদের ফোন ও ব্যক্তিগত সামগ্রী কেড়ে নেয়, যাতে তারা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে না পারে।
এইচআরডব্লিউ আরও মন্তব্য করেছে যে, মুসলিম-প্রধান বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ কয়েক দশক ধরে চললেও এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে এই সংখ্যা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ভারতের কর্তৃপক্ষ দাবি করছে যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে যারা ভারতে প্রবেশ করেছেন, তাদেরই বিতাড়িত করা হচ্ছে। যদিও বিতাড়িতদের অনেকেই নিজেদের বাংলাদেশি নাগরিক বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন, বহু মানুষ নিজেদের ভারতীয় নাগরিক বলেও দাবি করেছেন। সুষ্ঠু প্রক্রিয়া না থাকায় অনেক ভারতীয় নাগরিক, যাদের বেশিরভাগই বাংলাভাষী মুসলমান, তাদের বেআইনিভাবে বিতাড়িত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার বারবার বলেছে যে, প্রত্যর্পণের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি লঙ্ঘন করে ভারত সরকারের এই একতরফা সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় না। ঢাকা ভারতের কর্তৃপক্ষের কাছে ‘স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, যা পর্যবেক্ষণ করা যাবে’ এমন পদ্ধতি গ্রহণের আর্জি জানিয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ৮ মে তারিখে ভারত সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল যে তথাকথিত ‘পুশ-ইন’ গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকা আরও জানিয়েছিল, "শুধুমাত্র বাংলাদেশি নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং যাদের সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যর্পণ করা হবে, এমন ব্যক্তিদেরই তারা ফিরিয়ে নেবে।"
এইচআরডব্লিউ আরও জানিয়েছে যে, একই মাসে ভারত সরকার প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও আসামের একটি ডিটেনশন সেন্টার থেকে বিতাড়িত করে দেয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দফতরকে উদ্ধৃত করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, অন্য ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারের কাছে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে জোর করে, যেখানে তাদের কেবল লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সাঁতরে সমুদ্র পার হতে বলা হয়েছিল। এই ঘটনাকে জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুস "মানবিক শালীনতার অবমাননা" বলে বর্ণনা করেছেন।
মি. অ্যান্ড্রুসকে উদ্ধৃত করে এইচআরডব্লিউ আরও বলেছে যে, এই ঘটনা 'নন-রিফাউলমেন্ট' নীতির 'গুরুতর লঙ্ঘন'। এই আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে এমন জায়গায় ফেরত পাঠানো যায় না, যেখানে তার জীবন ও স্বাধীনতা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি ভারতকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, সব ধরনের জাতিগত বৈষম্য নিবারণে আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং অসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী ভারত এটা নিশ্চিত করতে বাধ্য যে, প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং জাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির ভিত্তিতে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হবে না।
ভারতের সরকার গত দুই-তিন মাসে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা নাগরিকদের 'বিতাড়ন' করা নিয়ে কোনো কথা বলেনি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে সরকারি মন্ত্রী-আমলারা মন্তব্য করেছেন যে 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ভারতে থাকার অধিকার নেই'।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ যে 'পুশ ব্যাক'-এর অভিযোগ করে, ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে 'পুশ-ব্যাক'-এর কথা স্বীকার করে না। তারা বলে থাকে, এমন কোনো শব্দ তাদের কর্মপদ্ধতিতে নেই।
তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএসএফ কর্মকর্তারা গত কয়েক মাসে বিবিসিকে বলেছেন যে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এত বেশি সংখ্যায় 'অনুপ্রবেশকারী' ধরা পড়ছে যে, তাদের কারাগারে আটক রাখতে গেলে সব জেল খালি করে দিতে হবে। তাছাড়া, প্রত্যর্পণের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি মেনে চলতে গেলে ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সহ একাধিক দপ্তরের মাধ্যমে পরিচয় যাচাই করার পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তাই 'পুশ-ব্যাক' করার পদ্ধতি তারা গ্রহণ করছেন বলে বিএসএফ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তবে যেসব ক্ষেত্রে 'ভুল করে ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে', তাদের অনেককে আবার ফিরিয়েও আনা হয়েছে বলে ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন: