জুলাই ২৫, ২০২৫, ১২:৫৪ পিএম
জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনও ঘোষণা করা না হলেও, নির্বাচিত নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের জন্য রাজধানীতে বাসা খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের জন্য হেয়ার রোডকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মন্ত্রীদের জন্য নতুন বাসভবন খোঁজা হচ্ছে, কারণ বর্তমান অনেক সরকারি আবাসন বিচারপতি ও উচ্চপদস্থ আমলাদের দখলে রয়েছে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গত ৭ জুলাই (২০২৫) উচ্চপর্যায়ের একটি ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল, যার প্রধান ছিলেন একজন অতিরিক্ত সচিব। এই কমিটি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিটির একজন সদস্য 'প্রথম আলো'কে জানিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। এই নির্বাচনের পর নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা কোথায় থাকবেন, তা নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা এবং হেয়ার রোডের ২৪ ও ২৫ নম্বর বাংলো বাড়িকে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের জন্য বিবেচনা করার সুপারিশ করা হয়েছে। ৩০ হেয়ার রোডে অবস্থিত যমুনার আয়তন প্রায় সোয়া তিন একর। যমুনার পাশের ২৪ ও ২৫ নম্বর বাংলো বাড়ি দুটি বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তায় নিয়োজিত একটি বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যবহার করছেন।
উল্লেখ্য, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তিন মেয়াদে গণভবনে অবস্থান করেছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে এখন জাদুঘর নির্মাণকাজ চলছে এবং আগামী ৫ আগস্ট এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। এর ফলে ভবিষ্যতে কোনো সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর আর গণভবনে থাকার সুযোগ থাকছে না।
নতুন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের জন্য আরেকটি সম্ভাব্য জায়গা নিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা ছিল— গণভবনের পেছনে যেখানে আগে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হতো, শেরেবাংলা নগরের সেই খালি জায়গা। তবে কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এই স্থানে নতুন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন করার বিষয়ে কোনো সুপারিশ করেনি। কমিটির একাধিক সদস্যের মতে, শেরেবাংলা নগর এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন করতে গেলে দুটি জটিলতা তৈরি হবে: প্রথমত, সংসদ ভবনসংলগ্ন ওই এলাকা মার্কিন স্থপতি লুই আই কানের নকশার আলোকে গড়ে উঠেছে, তাই সেখানে নতুন করে বড় স্থাপনা নির্মাণ করা ঠিক হবে না। দ্বিতীয়ত, নতুন নকশা করে স্থাপনা তৈরির বিষয়টি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। সব দিক বিবেচনা করে হেয়ার রোডে যমুনা ও এর আশপাশকে উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে।
রাজধানীর মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডে মন্ত্রীদের জন্য ১৫টি বাংলো বাড়ি এবং বেইলি রোডে 'মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট' নামে ৩০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া গুলশানের একটি সরকারি বাংলো বাড়িতেও মন্ত্রীরা থেকেছেন। সব মিলিয়ে ৪৬ জন মন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা আছে। এরপরও নতুন সরকারের মন্ত্রীদের জন্য কেন বাড়ি খুঁজতে হচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত ৩০টি ফ্ল্যাটের মধ্যে বর্তমানে ১২টিতে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিরা থাকছেন। বাকি ১৮টির মধ্যে ১৪টিতে দুজন উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার চারজন বিশেষ সহকারী, চারজন নির্বাচন কমিশনার এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের দুজন কমিশনারসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অবস্থান করছেন। যদিও বিচারপতি ও আমলাদের জন্য নির্ধারিত খালি ফ্ল্যাট রয়েছে, তবুও তারা 'মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট'-এ থাকছেন। সরকারি আবাসন পরিদপ্তর এটিকে বেআইনি না বললেও, একজন সাবেক বিচারপতি এটিকে অনৈতিক বলে মন্তব্য করেছেন।
কাকরাইলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য নির্মিত ২০ তলা আবাসিক ভবনে ৭৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার মধ্যে ২৪টি এখনও খালি পড়ে আছে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট খালি থাকায় বিচারপতিসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সেখানে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন সরকার গঠনের পর এসব ফ্ল্যাট থেকে সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তি বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সরানো বিব্রতকর হবে, তাই আগাম প্রস্তুতি হিসেবে মন্ত্রীদের জন্য নতুন বাসভবন খোঁজা হচ্ছে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে মিন্টো রোডের ৩৩ ও ৩৪ নম্বর বাংলোবাড়িকে (যথাক্রমে ৯০ ও ৯৭ কাঠা আয়তনের) আধুনিক ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করেছে, যেখানে অন্তত ১২ জন মন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা করা যাবে। বর্তমানে ৩৩ নম্বর বাংলোবাড়ি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং ৩৪ নম্বর বাংলোবাড়ি শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারের নামে বরাদ্দ রয়েছে।
একইভাবে, বেইলি রোডের ২০ ও ২১ নম্বর বাংলোবাড়িতেও (মোট ১২১ কাঠা আয়তনের) আধুনিক ভবন নির্মাণ করে আরও ১২ জন মন্ত্রী বা সমপর্যায়ের ব্যক্তির থাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে বলে কমিটি মনে করে। বর্তমানে ২০ নম্বর বাংলোবাড়ি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যানের নামে এবং ২১ নম্বর বাংলোবাড়ি খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের নামে বরাদ্দ।
তবে, মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডের বাংলোবাড়িগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকায় সেগুলো ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ কতটা যৌক্তিক হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, স্থাপত্য অধিদপ্তর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়েই সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এছাড়াও, কমিটি গুলশান (২১ কাঠা) ও ধানমন্ডিতে (২০ কাঠা) দুটি পরিত্যক্ত সরকারি বাড়িতে মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করেছে।
এই বিষয়ে এখন অন্তর্বর্তী সরকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
আপনার মতামত লিখুন: