সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৫, ১০:১১ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রায় নিরঙ্কুশ জয় হয়েছে, যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিজয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভোটের ব্যবধান হাজার হাজার। ডাকসুর ভিপি পদে বিজয়ী সাদিক কায়েম তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত আবিদুল ইসলাম খানের চেয়ে ৯ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে ছিলেন।
এই বিজয়ের পেছনে কোন 'ফ্যাক্টর বা অনুঘটক' কাজ করেছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ডাকসুর সাবেক ছাত্রনেতারা বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান:
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক ছাত্রনেতারা মনে করেন, এই বিজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হলো জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান। এই আন্দোলনের মূল পরিকল্পনা থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্ব পর্যন্ত শিবিরই ছিল, এমন একটি ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে। অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, 'গণ-অভ্যুত্থানের মালিকানা নিয়ে যে বাহাস ছিল, সেখানে শিবির বলেছে, গণ-অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনা থেকে আন্দোলনের নেতৃত্বের সব কিছুতে যেমন প্রোফাইল লাল করা, এক দফার দাবি, স্লোগান সব কিছুর মূলে ছিল তারা।' এই ন্যারেটিভ ভোটারদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের দুর্বলতা:
বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের ব্যর্থতাও শিবিরের বিজয়ে সহায়ক হয়েছে। ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন মনে করেন, স্বাধীনতার পর থেকে প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা থেকে বর্তমান প্রজন্ম আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নানা প্রতিশ্রুতিতে তরুণ প্রজন্ম তাদের সুযোগ দেওয়ার কথা বিবেচনা করেছে। তিনি মনে করেন, 'জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে র্যাডিকেল ইসলামিস্ট শক্তি যে ভূমিকাটা নিয়েছে, সেটা না হলে শেখ হাসিনার শক্তিশালী শাসনের হাত থেকে মুক্ত হওয়া যেতো না। এটি সিমপ্যাথি হিসেবে হয়তো কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়।'
আন্ডারগ্রাউন্ড কার্যক্রম:
দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে ছাত্ররাজনীতিতে শিবিরের উপস্থিতি কম থাকলেও, বিশ্লেষকরা মনে করেন যে তারা 'আন্ডারগ্রাউন্ডে' থেকে নিজেদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা প্রকাশ্যে এসেছে এবং তাদের সংগঠিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই বিজয় অর্জন করেছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শিবিরের অবস্থা:
মুশতাক হোসেন জানান, নব্বইয়ের দশকে ঢাবিতে ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে তাদের সংঘাত হয়, যা তাদের বিরুদ্ধে 'অচ্ছুত নিষেধাজ্ঞা' তৈরি করে। এরপর থেকে তারা গোপনে রাজনীতি চালিয়ে গেছে। কিছু নেতার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের পদ-পদবি নিয়ে নিজেদের সংগঠিত করারও অভিযোগ রয়েছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ:
মুশতাক হোসেন সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, শিবির যদি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী পথে যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ সংঘটিত হতে বেশি সময় লাগবে না। তিনি তাদের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে 'লিবারেল ডেমোক্রেটিক' ধারার রাজনীতির সামঞ্জস্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
এই বিজয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।