বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০২৫, ৯ শ্রাবণ ১৪৩২

মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

জুলাই ২২, ২০২৫, ০৬:০৫ পিএম

মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ

ছবি- সংগৃহীত

রাজধানীর আকাশে হঠাৎ করেই নেমে এসেছিল বিষাদের ছায়া। উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের আকাশ ছুঁয়ে হঠাৎই ধসে পড়ে একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। মুহূর্তেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আগুন, ধোঁয়া আর আতঙ্ক।

স্কুলের মাঠে, শ্রেণিকক্ষে, বারান্দায়—সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে হতাহত শিক্ষার্থীদের কান্না আর আর্তনাদ। ঘটনাস্থলে ছুটে আসে উদ্ধারকারী দল, শুরু হয় উদ্ধার অভিযান।

কিন্তু এই দুর্যোগের সময়ে এক অনন্য দৃশ্যের সাক্ষী হলো জাতি।


হ্যাঁ, রক্ত দিতে, জীবন বাঁচাতে, পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এলেন সমাজের সেই একদল মানুষ—যাদের আমরা বহুবার উপেক্ষা করি, অবহেলা করি।

তারা কেউ পরিচিত ‘হিজড়া’ হিসেবে, কেউ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলে সমাজে বঞ্চনার শিকার। কিন্তু আজ তারা দেখিয়ে দিলেন—সহানুভূতি, মানবতা ও দায়িত্ববোধ কোনো পরিচয়ের মুখাপেক্ষী নয়।

 
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ছুটে যান রাজধানীর বার্ন ইনস্টিটিউটে।

কারো হাতে ছিলো রক্তদানের কার্ড, কেউ আবার লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাদের চোখে মুখে ছিল সহানুভূতির দীপ্তি, হৃদয়ে ছিল দেশের জন্য ভালোবাসা।

তাদের একজন বলছিলেন, “আমরাও তো এই দেশেরই সন্তান। কেন বসে থাকবো? ওরা আজ বিপদে পড়েছে, কাল আমাদেরও হতে পারে। পাশে না দাঁড়ালে কী করে বলবো, আমরা মানুষ?”

 
সেই মানুষগুলো, যাদের আমরা প্রতিনিয়ত নানা দৃষ্টিতে দেখি, তারা আজ সমাজকে মানবতার পাঠ পড়াচ্ছেন। রক্ত দিয়ে প্রমাণ করছেন—জীবন বাঁচানোই সবচেয়ে বড় ধর্ম।

তারা বলছিলেন, “আমরা তো চাই না কেউ মারা যাক, কেউ যেন কষ্ট না পায়। আমরা এসেছি শুধু একটা কাজ করতে—রক্ত দিতে। যাতে কারও মা ছেলেকে হারান না, কারও পরিবার ছিন্নভিন্ন না হয়।”

 
একজন রক্তদাতা জানান, তিনি নিজেও ছোটবেলায় একটি অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বুঝতে পারেন, দগ্ধ রোগীদের কতটা কষ্ট। তাই কোনো কিছু না ভেবে ছুটে এসেছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে।

তার চোখে ছিল জল, কণ্ঠে কাঁপন—“আমার শরীরেও আগুনের দাগ আছে। আমি জানি, এই যন্ত্রণা কেমন। তাই আজ আমি এখানে।"

 
তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলো কেবল রক্ত দেননি, তারা দিয়েছেন একটি বার্তা—"ভালোবাসা হোক সবার জন্য, মানবতা হোক একমাত্র পরিচয়।"

তারা আজ প্রমাণ করেছেন—লিঙ্গ নয়, পোশাক নয়, পরিচয় নয়—মূল পরিচয় একটাই, মানুষ।


এই ঘটনায় আমরা দেখেছি, যন্ত্রের গর্জনের চেয়ে মানুষের ভালোবাসার গর্জন অনেক বেশি শক্তিশালী। যুদ্ধবিমানের দুর্ঘটনায় যখন চারপাশ থমকে গেছে, তখনও মানবতার আলো নিভে যায়নি।

আর এই আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন সেই সব নিঃস্বার্থ মানুষ, যাদের সমাজ আজও সম্পূর্ণভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।

তবে তারা অপেক্ষা করেন না স্বীকৃতির, তারা দেন কাজের প্রমাণ।

 
জীবনের গল্প বড়ই বিচিত্র। কোথায় কখন কার ভূমিকা হয়ে ওঠে অনন্য, তা আমরা আগেভাগে বুঝতে পারি না।

আজকের এই প্রজন্ম, যারা রক্ত দিলেন, তারা হয়তো কোনো বইয়ের পাতায় জায়গা পাবেন না।
তাদের নিয়ে হয়তো কোনো সিনেমা হবে না।
কিন্তু তারা রয়ে যাবেন—আন্তরিকতা আর ভালোবাসার অদৃশ্য এক অধ্যায়ে।


আজ যদি একটি দুর্ঘটনা আমাদের একত্র করতে পারে,
আজ যদি রক্তের বন্ধন মানুষকে মানুষ হিসেবে এক করে দিতে পারে—
তবে কেন আমরা প্রতিদিন বিভাজনে ডুবে থাকি?


আজ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তা আমাদের সবাইকে ভাবতে শেখায়।
এই সমাজ শুধু তাদের দুঃখ দিয়ে যাবে না—সম্মান দিয়েও ফিরিয়ে দেবে।

 
আমরা ধন্য সেই মানবতার জন্য, ধন্য সেই হৃদয়ের জন্য,
যেখানে একেকজন মানুষ একেকটা আশার আলো হয়ে উঠে দাঁড়ান।

 
মানবতা জিতুক। ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ুক চারদিকে।
লিঙ্গ নয়, পোশাক নয়, পরিচয় নয়—একটাই পরিচয়—আমি মানুষ।