আগস্ট ১১, ২০২৫, ১০:২১ এএম
২০১৪ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে লালগালিচা বিছিয়ে স্বাগত জানানো এবং নদীর তীরে দোলনায় বসে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখার পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে এক নতুন এবং অপ্রত্যাশিত মোড় দেখা যাচ্ছে। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে পুঁজি করে চীনের মোকাবিলা করতে চাইলেও, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ভারতের জন্য এক আত্মসমালোচনার মুহূর্ত তৈরি করেছে। এর ফলে ভারত এখন পুরোনো ‘কৌশলগত স্বনির্ভরতা’র নীতিতে ফিরে এসে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মোদি-চিন পিং থেকে মোদি-ট্রাম্পের যাত্রা
মোদি ও চিন পিংয়ের দোলনাঝুলনের পরপরই সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে ভয়ংকর উত্তেজনা ও সংঘাত দেখা গিয়েছিল, যেখানে চীন ভারতের অনেকখানি ভূমি দখল করে নেয়। ওই ঘটনা মোদিকে বিব্রত করে এবং হিমালয় অঞ্চলের উচ্চভূমিতে কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার ভারতীয় সেনা মোতায়েন রাখতে বাধ্য করে, যা ভারতের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করে।
ওই ঘটনার পর মোদি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকলেন। শীতল যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ধীরে ধীরে উষ্ণ হতে থাকা সম্পর্ককে দ্রুত এগিয়ে নিতে মোদি নিজের রাজনৈতিক পুঁজি খরচ করেন। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময় তাদের এমন সম্পর্ক গড়ে উঠল যে মোদি প্রটোকল ভেঙে হিউস্টনের স্টেডিয়ামে ভরা জনসমাবেশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ভারতীয় মার্কিন ভোটারদের কাছে ভোট চেয়ে বসেছিলেন।
ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর জো বাইডেন এলেও বাইডেন প্রশাসন দলীয় রাজনীতি উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ককে চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অংশীদারি হিসেবে আরও সম্প্রসারণ করতে লাগল। মোদি এক যৌথ অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘“এ. আই” মানে “আমেরিকা অ্যান্ড ইন্ডিয়া”।’
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের ধাক্কা: ভারতের প্রতি আগ্রাসী শুল্ক ও পাকিস্তান নীতি
কিন্তু হঠাৎ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে মোদির জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প ভারতকে নিশানা করে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, কারণ ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কিনছে। ট্রাম্প ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি চলতি বছরের শুরুতে পাকিস্তানের নেতৃত্বকে ভারতের সমান মর্যাদা দিয়েছেন; যদিও এর আগে তিনি পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক বলেছিলেন। সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই বেঁধে যায় এবং কয়েক দিন পর দুই দেশ অস্ত্রবিরতিতে যায়। ট্রাম্প দাবি করেছেন, তাঁর মধ্যস্থতায়ই ভারত-পাকিস্তান বিরোধ মিটেছে।
এইসব ঘটনা ভারতের জন্য এক আত্মসমালোচনার মুহূর্ত তৈরি করেছে। কারণ দেখা যাচ্ছে, আকারে বিশাল ও অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান হলেও ভারতের বিশ্বমঞ্চে ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মোদি স্বীকার করেছেন, এই বাণিজ্যবিরোধের কারণে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে।
চীনের সঙ্গে পুনর্মিলনের চেষ্টা ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা
এখন কিছুটা উষ্ণতা ফেরানোর জন্য চীনের সঙ্গে আবার ভারত যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। সাত বছর পর চলতি মাসের শেষে মোদির চীন সফরের কথা রয়েছে। তবে সীমান্ত সংঘাত ও পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতায় চীনের প্রকাশ্য সমর্থন সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়িয়ে রেখেছে। পাশাপাশি চীন ভারতকে বিকল্প উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকে সন্দেহের চোখে দেখছে।
মোদি বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন। তিনি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা (যিনি নিজেও ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্যবিরোধে আছেন) এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন। উভয় পক্ষই ‘ভারত-রাশিয়া বিশেষ ও সুবিধাজনক কৌশলগত অংশীদারত্ব’ আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পুতিনের নয়াদিল্লি সফরের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে মস্কো গেছেন।
সম্পর্কের মূল সমস্যা: ব্যক্তি নির্ভরতা
বিশ্লেষকদের মতে, সমস্যার মূল কারণ হলো এখন দুই দেশের সম্পর্ক রাষ্ট্রের বদলে দুই নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে। ট্রাম্প আর মোদি দুজনই খুব ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও অহংকারী স্বভাবের। তাই সম্পর্কের ভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ভারতের সাবেক কূটনীতিক নিরুপমা রাও বলেছেন, ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত দুই দশক ধরে গড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্বের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাই ভারত এখন বাস্তবতা মেনে কৌশল বদলাবে, যাতে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা যায়।
ট্রাম্পের অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক আরোপ হয়তো ভারতের ওপর চাপ তৈরি করার কৌশল, যাতে ভারত নতুন বাণিজ্যচুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মানতে বাধ্য হয়। একই সঙ্গে এটি রাশিয়াকেও চাপ দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে, যেন তারা ইউক্রেন ইস্যুতে ছাড় দেয়। রাশিয়ার তেলের ব্যাপারটি আলোচনায় আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের মধ্যে বাণিজ্যঘাটতি কমানো নিয়ে অগ্রগতি হচ্ছিল। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে রাজি হয়েছিল। কয়েক দফা আলোচনার পর দুই দেশের মধ্যে প্রথম ধাপের চুক্তি প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ভারত নিজের দীর্ঘদিনের সুরক্ষিত কৃষিবাজারও আংশিকভাবে খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সাবেক জি-২০ দূত অমিতাভ কান্ত বলেছেন, ট্রাম্প অন্য মিত্রদেশগুলোর সঙ্গেও একই কৌশল ব্যবহার করেছেন। তাই এখনো একটি পারস্পরিক লাভজনক চুক্তির সম্ভাবনা আছে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, বাণিজ্য সমস্যা মিটলেও পারস্পরিক বিশ্বাস পুরোপুরি ফিরবে না।
চীনের আগ্রাসনের ঘটনায় দেখা গেছে, মোদি প্রকাশ্যে তেমন হইচই না করে শান্তভাবে সংকট সমাধানের চেষ্টা করেছেন। সীমান্তে চীনের হামলার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও নৌবাহিনীর সহযোগিতা বাড়ালেও সরাসরি চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার হয়ে কাজ করা থেকে বিরত থেকেছেন। এ কারণে গত অক্টোবর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্প যখন ভারতের ওপর বেশি শুল্ক বসালেন, তখন মোদি স্পষ্টভাবে বললেন, ভারত তার কৃষক, জেলে ও দুগ্ধশিল্পীদের স্বার্থে কোনো আপস করবে না। তিনি জানেন, এর জন্য তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে বড় রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে। তবু তিনি প্রস্তুত।
বিশ্লেষকদের মতে, সমস্যার মূল কারণ হলো এখন দুই দেশের সম্পর্ক রাষ্ট্রের বদলে দুই নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে। ট্রাম্প আর মোদি দুজনই খুব ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও অহংকারী স্বভাবের। তাই সম্পর্কের ভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
সূত্র:নিউইয়র্ক টাইমস (মূল ইংরেজি প্রতিবেদন)