জুলাই ২৩, ২০২৫, ০২:৩২ পিএম
গ্রামাঞ্চলে খিচুড়ি এখনো একরকম 'কম দামি' পদ হিসেবে পরিচিত। অতিথি আপ্যায়নে ভুলেও এই পদ ভাবা যায় না, বরং বাড়িতে যেদিন কিছুই থাকে না, সেদিন খিচুড়ির কথা মনে পড়ে। তারপরও কম সমাদরে বেড়ে ওঠা এই খাবার কিন্তু কখনো বাঙালির হেঁশেল থেকে হারিয়ে যায়নি। শত শত বছর ধরে সে টিকে আছে নিজের মতো করে। আর বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি হবে, এটা তো বাঙালিমাত্রেরই জানা। সামর্থ্যমতো কেউ রাঁধবেন মুগ আর কালিজিরা চালের ভুনা খিচুড়ি, কেউ সেদ্ধ চালে কয়েক রকম ডাল দিয়ে ঝরঝরে খিচুড়ি। আর চাল-ডালের সঙ্গে একটু আনাজপাতি আর এক হাঁড়ি পানি দিয়ে অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবারে রান্না হবে বিশেষ এক খিচুড়ি—ল্যাটকা। অঞ্চলভেদে এই ল্যাটকাই কোথাও ঢিলা খিচুড়ি, ল্যাটা বা গলা খিচুড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
একে তো খিচুড়ি, তার ওপর আবার ঢ্যালঢেলে—এরকম খাবার কি শহুরে বাবুদের মন জোগাতে পারবে? আলবত পারবে। সত্যি বলতে, পারছেও। টানা বৃষ্টিতে অন্ধকার হয়ে আসা দিনগুলোয় গ্রামে যে পাতলা খিচুড়ি তৈরি হতো, সেটাই এখন শহুরে নাগরিকদের শখের খাবার। এসি রেস্তোরাঁয় সিরামিকের প্লেটে অথবা পারিবারিক বিশেষ পার্টিতে পাতলা সেই খিচুড়ি নিজের স্থান পোক্ত করতে শুরু করেছে।
খিচুড়ি কি বাঙালির নিজস্ব খাবার?
এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর একবাক্যে দেওয়া দুষ্কর। কিছুটা ইতিহাস ঘাঁটা যাক।
১৬৭০ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রথমবার এর স্বাদ আস্বাদন করেছিলেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর। ভারতের খমভট থেকে আহমেদাবাদ যাওয়ার পথে কোসালা নামক এক গ্রামে লটবহর নিয়ে থেমেছিলেন সম্রাট। সেখানে নতুন ধরনের একটা খাবার খেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ‘বাজরা খিচড়ি’। ‘গুজরাটিদের কেউ কেউ এটাকে লাদরা বলেও ডাকে’, লিখেছিলেন সম্রাট। এভাবেই বাদশাহ জাহাঙ্গীরের হেঁশেলে প্রবেশ করে বিশেষ সেই খিচুড়ি। তবে এরও বহু আগে থেকেই মোগল রন্ধনশালায় খিচুড়ি রান্না হয়েছে, জাহাঙ্গীর হয়তো চেখে দেখেননি। আইন-ই-আকবরির প্রথম খণ্ডেই বাদশাহি হেঁশেল অধ্যায়ে অল্প যে কয়েকটি খাবারের নাম উল্লেখ আছে, তার মধ্যে ৩ নম্বরে চোখে পড়বে খিচুড়ি।
একইভাবে মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যেও খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়, তবে ধরনটা একটু ভিন্ন। ইবনে বতুতাও ভারতবর্ষে এসে খেয়েছিলেন কিশরি, যা মূলত খিচুড়িরই আরেক নাম। গ্রিক দূত সেলুকাসও এই অঞ্চলে চাল-ডালে মেশানো খাবারের কথা বলেছেন। এমন আরও অনেক লেখাতেই এসেছে খিচুড়ি প্রসঙ্গ। আর এ কথা বলতেই হয়, এটা শুধু বাঙালির খাবার নয়, ভারতবর্ষজুড়েই বিভিন্ন স্থানে খিচুড়ি খাওয়ার চল বহু পুরোনো।
‘বাংলার কৃষি ও কৃষক’ বইতে নানা রকম চালের বর্ণনা করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের লেখক অনুপম পাল বরিশাল অঞ্চলের আশাইল নামের একটি চালের কথা লিখেছেন। এই চাল নাকি শুধু খিচুড়ি রান্নার জন্যই চাষ করা হতো। এই চালের বিশেষত্ব হলো, রান্নার মাঝামাঝি অবস্থায় এসে চালটি ফেটে যায়। পাকা রাঁধুনিরা এ কথা একবাক্যে স্বীকার করবেন, রান্নার মধ্যে চাল ফেটে তার মধ্যে ডাল আর মসলার রস ঢুকলেই তো তৈরি হবে অমৃত স্বাদের খিচুড়ি।
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের জনপ্রিয় এই খাবার যতই ইংল্যান্ডে গিয়ে কেজিরি বা ইতালিতে রিসত্তো হোক না কেন, আদর-ভালোবাসায় খিচুড়ি যে বাঙালির ‘বাপের সম্পত্তি’ হয়ে উঠেছে, সেটা স্বীকার করতেই হবে।
ল্যাটকা খিচুড়ির জাতে ওঠা-
যত গৌরবময় বংশপরিচয়ই থাকুক না কেন, আগেই বলেছি, এই সেদিনও গ্রামবাংলার মানুষের কাছে খিচুড়ি ছিল কম দামি পদ। খিচুড়ির মধ্যেও আবার সবচেয়ে অবহেলিত ছিল ল্যাটকা। অবহেলিত সেই ধরন এখন শ্রেণিগত উত্তরণ ঘটিয়ে জেন-জিদের জিবেও সমাদৃত হচ্ছে। হঠাৎ করে ল্যাটকা খিচুড়ির এই বাড়বাড়ন্ত দেখে প্রবীণরাও অবাক। গুলশানের প্রিমিয়াম সুইটসে এই ল্যাটকা খিচুড়ি ৯০০ টাকায় বিক্রি হয় শুনে আমার মায়ের তো প্রায় মূর্ছা যাওয়ার দশা। মা যতই ঠাট্টা করুন, প্রিমিয়ামের কালাভুনাসহ ল্যাটকা খিচুড়ি যিনি একবার খেয়েছেন, তিনি দ্বিতীয়বার খেতে চাইবেন। আর দামেও যেহেতু ঝাঁজালো, তাই সেটাকে আর গরিবি পদ বলারও সুযোগ নেই। ঝরঝরে বা ভুনা খিচুড়ির জন্য আগে থেকেই ঢাকার হীরাঝিল, কুকারস সেভেনের মতো অনেক দোকান বিখ্যাত। তবে ল্যাটকা খিচুড়ি সেখানে মেলে না।
বেশ কয়েক বছর ধরে শহুরে বাবুদের চাহিদা মেটাতে গড়ে উঠেছে অনেক ল্যাটকা খিচুড়ির দোকান। কারওয়ান বাজারের শাহী মোগল বিরিয়ানির দোকানের ল্যাটকাও সম্প্রতি বেশ নামডাক ছড়াচ্ছে। বনানীর যাত্রা বিরতি, স্বাদে বাংলাদেশ থেকে মিরপুরের বাঙালিয়ানা ভোজ বা ধানমন্ডির এন’স কিচেন ইত্যাদি রেস্তোরাঁয় ৫০ টাকা থেকে প্রায় ১ হাজার টাকায় খেতে পারবেন ল্যাটকা খিচুড়ি। কেউ ল্যাটকার সঙ্গে রাখছেন কালাভুনা, কষা মাংস, মুরগি বা হাঁসের পদ, কোথাও শুধু সবজির ট্যালটেলে খিচুড়ির সঙ্গে একটা ডিম। সেটা ভুনা বা ভাজা, যেকোনোভাবেই পরিবেশিত হতে পারে। তবে বেশির ভাগ দোকানেই একটা বিষয় কমন, সেটা আচার। ল্যাটকা খিচুড়ির সঙ্গে ভালো যায় নানা রকম ভাজাপোড়া। পানি পানি খিচুড়ির সঙ্গে মুচমুচে ঝিরি আলুভাজার সংগতও কম উপভোগ্য নয়। হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজার একটা ছোট্ট দোকান মা খাবার ঘর-এ ২০০ টাকায় ঝুরা মাংসের সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে ল্যাটকা খিচুড়ি। এটার স্বাদও আপনাকে ল্যাটকারসিক করে তুলতে পারে।
জগাখিচুড়ি বলে বাংলায় যে এলোমেলো বা অগোছালো অবস্থাকে বোঝানো হয়, সেই জগাখিচুড়ি কিন্তু নিজেই নরম খিচুড়ির এক পদের নাম। জগন্নাথমন্দিরের ভোগ হোক বা জগা নামধারী সাধকের করা রান্নাই হোক, তা খেতে যেমন স্বাদু, পুষ্টিগুণেও অনন্য।
পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা:
বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামছুন্নাহার নাহিদ জানালেন, রান্নার ওপর নির্ভর করে এক প্লেট খিচুড়ি দিয়ে একজন মানুষের দেহে প্রয়োজনীয় ৬টি পুষ্টি উপাদানের সব কটিই পাওয়া সম্ভব। ল্যাটকা খিচুড়িতে যেহেতু পানির পরিমাণ বেশি থাকে, সেটা শরীরের জন্য বেশি ভালো। ভুনা খিচুড়ির তুলনায় ল্যাটকা সহজে হজমও হয়।
তথ্যসূত্র: নীলাঞ্জন হাজরার খিচুড়ি ও অনুপম পালের বাংলার কৃষি ও কৃষক
আপনার মতামত লিখুন: