জুলাই ২৩, ২০২৫, ১১:২৩ এএম
ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মোসাম্মৎ সাগরিকা এখন দেশের নারী ফুটবলের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, বিশেষ করে নেপালের বিপক্ষে অঘোষিত ফাইনালে চারটি গোল করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করার মধ্য দিয়ে তিনি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব ফুটবলে আলো ছড়াচ্ছেন। তার এই উত্থান কেবল একটি খেলার গল্প নয়, এটি দারিদ্র্য, সামাজিক বাধা এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক প্রতিচ্ছবি।
আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাগরিকার জীবনের পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। রাণীশংকৈল উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ে রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামের একটি জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরে তার বেড়ে ওঠা। বাবা লিটন আলীর একটি ছোট চায়ের দোকান, আর ভাই মোহাম্মদ সাগর ইটের ভাটায় কাজ করেন। এই চরম দারিদ্র্যের মধ্যেই ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখেছিলেন সাগরিকা। মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, একসময় ফুটবল খেলার কারণে সমাজের বিভিন্ন অংশের কটূক্তি এবং বাবার বারণও তাকে দমাতে পারেনি। সাগরিকার বাবা লিটন আলী প্রথমে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে সমাজের 'লোকে কী বলবে' এই ভয়ে মেয়েকে ঘরে আটকে রাখতেন। কিন্তু সাগরিকার অদম্য জেদ এবং রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তিনি শেষ পর্যন্ত মেয়ের স্বপ্ন পূরণে বাধা দেননি।
সাগরিকার কোচ গোলাম রব্বানীর মতে, শারীরিক গঠন ফুটবল উপযোগী না হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাগরিকার মাঝে এক বিশেষ প্রতিভা দেখেছিলেন। কোচ তাকে অনেকটা জোর করেই ক্যাম্পে নিয়েছিলেন এবং তার বিশ্বাস ছিল, সঠিক পরিচর্যা পেলে সাগরিকা একদিন দেশের ফুটবলের সম্পদ হবেন। আজ সাগরিকা তার পারফরম্যান্স দিয়ে সেই বিশ্বাসকে প্রমাণ করেছেন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, মানুষ এখন তাকে চিনতে পারে, আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকায় – যা তার কাছে এখনো কিছুটা অভ্যাসের বাইরে।
দুই বছর আগে ২০২২ সালে বাংলার মেয়েরা প্রথম সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় এই বছর হিমালয়কন্যাদের ২-১ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতেছে লাল-সবুজের মেয়েরা। এই দলের এক গর্বিত সদস্য সাগরিকা, যিনি নেপালের বিপক্ষে ফাইনালে একাই চার গোল করে দলের জয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এই টুর্নামেন্টে তিনি দুটি হ্যাটট্রিকও করেছেন এবং টুর্নামেন্টের মোস্ট ভ্যালুয়েবল খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন।
সাগরিকার ফুটবল ক্যারিয়ারের এই সাফল্য শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনেই পরিবর্তন আনেনি, তার পরিবারের জীবনেও এনেছে স্বস্তি। একসময় অন্যের জমিতে জরাজীর্ণ বাড়িতে বসবাস করা সাগরিকার পরিবার এখন একটি দু'কক্ষের নতুন পাকা বাড়ি পাচ্ছে। সাগরিকার মা আনজু আরা এবং বাবা লিটন আলী দুজনেই উচ্ছ্বসিত। বাবা, যিনি একসময় মেয়েকে খেলতে নিষেধ করতেন, এখন গর্বিত। তিনি জানান, মেয়ের খেলা দেখার জন্য পাশের গ্রামের খালার কাছ থেকে টিভি এনে দোকানে লাগিয়েছেন এবং গ্রামে বড় পর্দায় তার খেলা দেখানো হয়েছে।
সাগরিকা নিজেই জানান, তাজু স্যার (তাজুল ইসলাম) তাকে হাতে-কলমে ফুটবল শিখিয়েছেন এবং তার কাছে এক বছর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর বিকেএসপিতে ট্রায়াল দিয়ে তিনি টিকে যান। যদিও পরে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন, কিন্তু তাজু স্যারের আস্থা এবং পরবর্তীতে জাতীয় দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানীর নজরে পড়ার মধ্য দিয়ে তার ফুটবলের যাত্রা নতুন মোড় নেয়।
সাগরিকার বর্তমান লক্ষ্য জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া। তিনি বলেন, "অনূর্ধ্ব-১৭ ও ১৯ পেরিয়ে আমার লক্ষ্য জাতীয় দল। আমাদের জাতীয় দল খুবই ভালো। সেখানে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করা ছাড়া জায়গা পাওয়া খুবই কঠিন। আমাকে এখন প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হবে।" দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার পর সাগরিকাদের এখন লক্ষ্য এশিয়ার মঞ্চে ভালো করা।
সাগরিকার এই গল্প কেবল একজন ফুটবলারের সাফল্যগাঁথা নয়, এটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজারো প্রতিভাকে অনুপ্রাণিত করার এক জীবন্ত উদাহরণ। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম এবং সঠিক সুযোগ পেলে যে কোনো প্রতিকূলতা জয় করা সম্ভব, সাগরিকা তা আবারও প্রমাণ করে দিলেন।
আপনার মতামত লিখুন: