মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২

নবাবগঞ্জে ৩ হাজার পরিবার এখন স্বাবলম্বী: ইসলামিক রিলিফের “সাপোর্ট”

মোঃ মোমিনুল ইসলাম

আগস্ট ১১, ২০২৫, ০৬:৫৯ পিএম

নবাবগঞ্জে ৩ হাজার পরিবার এখন স্বাবলম্বী: ইসলামিক রিলিফের “সাপোর্ট”

ছবি-মোঃ মোমিনুল ইসলাম | দিনাজপুর টিভি

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে নেমে এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। আগে যেসব পরিবার জীবিকার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী ছিল, আজ তারা নিজেরাই স্বাবলম্বী। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের উদ্যোগে পরিচালিত “সাসটেইনেবল লাইভলিহুডস ডেভেলপমেন্ট অব দ্য এক্সট্রিম পুওর কমিউনিটিজ (সাপোর্ট)” প্রকল্পের বহুমুখী কার্যক্রমের ফলেই এই সাফল্য এসেছে।

নবাবগঞ্জ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ৩১৫টি সাওতাল ও তুরী পরিবারের পাশাপাশি আরও তিন হাজার প্রান্তিক পরিবারের জীবনমান উন্নয়ন, আয় বৃদ্ধি, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাস্তবায়িত হচ্ছে এই প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় কৃষি, হাঁস-মুরগি পালন, ছাগল পালন, গরু মোটাতাজাকরণ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও নেতৃত্বগুণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অনেক পরিবারকে এককালীন আর্থিক সহায়তা দিয়ে আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড শুরু করতে সহায়তা করা হয়েছে।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে ১২১টি নারীভিত্তিক স্বনির্ভর গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। তারা নিয়মিত সঞ্চয় করছে, নিজেদের মধ্যে থেকে সুদবিহীন ঋণ দিচ্ছে এবং মুষ্টিচালভিত্তিক খাদ্য ব্যাংক পরিচালনা করছে। এতে শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নিশ্চিত হয়নি, বরং পারস্পরিক সহযোগিতার মানসিকতা বেড়েছে। পরিবারগুলোর সদস্যদের হাতে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত জ্ঞানও দেওয়া হচ্ছে, যা তাদের উদ্যোগকে আরও টেকসই করছে।

রঘুনাথপুর গ্রামের সাওতাল সনমনি কিসলু বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে তিনি চরম বিপাকে পড়েছিলেন। খাবারের টাকার জন্য কষ্ট করতে হতো, সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইসলামিক রিলিফ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং এককালীন ২০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়ে তিনি গরু কিনেছেন। এখন তার ঘরে তিনটি গরু, পাঁচটি ছাগল ও অসংখ্য হাঁস-মুরগি রয়েছে। আয় দিয়ে সংসার চলে ভালোভাবে, সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন। আরেকজন আরতি কিসলু জানান, আগে ব্যবসা করার সাহস পাননি। প্রশিক্ষণ নিয়ে মুদি দোকান খুলেছেন এবং ভালো আয় করছেন। শুধু তাই নয়, পাড়ার মানুষের নানা সমস্যায় পাশে দাঁড়াচ্ছেন, সরকারি সেবা নিতে সহায়তা করছেন এবং কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ করছেন।

 

হিরচাঁদ গ্রামের শ্রীমতি শেফালী বালা জানান, একসময় তাদের পরিবারের খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হতো। আজ তার হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল এবং সবজি বাগান রয়েছে। সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে তিনি আনন্দিত।

প্রকল্পটি কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের নয়, কিশোরীদের জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রঘুনাথপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আফরিন নাহার নিপা জানান, ইসলামিক রিলিফ তাদের বিদ্যালয়ে সেনিটারি ভেন্ডিং মেশিন দিয়েছে। আগে পিরিয়ডের সময়ে স্কুলে আসতে ভয় লাগত, এখন সেই ভয় কেটে গেছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা এবং অধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাওয়ায় তারা বাল্যবিয়ে ও ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পেরেছে।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্প ব্যবস্থাপক কাজল কুমার বসাক বলেন, দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকার এই প্রকল্প শুধু আয়ের পথ খুলে দেয়নি, বরং সম্মিলিতভাবে সংগঠিত হওয়ার, অধিকার আদায়ের এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সংগ্রামে অংশ নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। প্রান্তিক নারীরা আজ নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অধিকার নিয়ে কথা বলছেন এবং নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন—এটাই প্রকৃত পরিবর্তনের সূচক। তিনি বলেন, এই পরিবর্তনকে আমরা টেকসই ও স্থায়ী দেখতে চাই।

 

বিনোদনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ইসলামিক রিলিফের কার্যক্রমে দারিদ্র্য বিমোচনে যে পরিবর্তন এসেছে, তা ব্যতিক্রমী। এই মডেলটি অন্য সংস্থার জন্যও অনুসরণযোগ্য।

অ্যাডভোকেসি ও যোগাযোগ সমন্বয়কারী সফিউল আযম বলেন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইসলামিক রিলিফ ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে। প্রান্তিক মানুষের উন্নয়ন, মর্যাদা এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তারা সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। নবাবগঞ্জের এই প্রকল্প সেই কাজেরই একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

এই প্রকল্পের আওতায় নেতৃত্ব উন্নয়ন, নারী ও পুরুষের অধিকার, মানবাধিকার ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু সহনশীল কৃষি ও পশুপালন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, স্কুলভিত্তিক স্বাস্থ্যবিধি শিক্ষা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হুইলচেয়ারসহ বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ফলে, নবাবগঞ্জ এখন একটি সামগ্রিক উন্নয়ন মডেল হিসেবে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।