মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২

সাড়ে তিন বছরেও চূড়ান্ত হয়নি কয়লা সরবরাহকারী

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

আগস্ট ১১, ২০২৫, ১১:৩১ এএম

সাড়ে তিন বছরেও চূড়ান্ত হয়নি কয়লা সরবরাহকারী

ছবি- সংগৃহীত

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র যৌথভাবে নির্মাণ করেছে আরপিসিএল ও নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড (আরএনপিএল)। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও দীর্ঘমেয়াদি (পাঁচ বছর) কয়লা আমদানির জন্য যোগ্য সরবরাহকারী চূড়ান্ত করতে না পারায় কেন্দ্রটি চালু নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অথচ বিদেশি বিনিয়োগে স্থাপিত কেন্দ্রটির গত জুনেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল।

বর্তমানে চতুর্থ দফায় দরপত্র মূল্যায়নে কারিগরিভাবে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবে কয়লার দাম নিয়ে আপত্তি তুলে প্রস্তাবটি আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী সেলিম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দরপত্রের আর্থিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত দরকে সাশ্রয়ী উল্লেখ করা সত্ত্বেও এই আপত্তি তোলা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেডের (আরএনপিএল) বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম ভূঁইয়া কালবেলাকে বলেছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের পরামর্শে পুনঃদরপত্র ডাকা হয়েছে, কারণ এর আগে ডাকা টেন্ডারে সিঙ্গেল বিডার ছিল।

দরপত্র কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সদস্য এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিচালক মাকসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততার কথা জানিয়ে ফোন রেখে দেন। পরে বিষয়টি নিয়ে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটি নরিনকোর বিষয় এবং তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন না।

নথিপত্র ও আরএনপিএল সূত্রের তথ্যমতে, চতুর্থ দফায় ডাকা দরপত্রের বিষয়ে গত ৩১ মে অনুষ্ঠিত আরএনপিএলের বোর্ড সভায় কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন অনুমোদন হয়। এতে ইয়াংথাই এনার্জিকে কারিগরিভাবে যোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং বাকি তিনটি কোম্পানিকে অযোগ্য ঘোষণা করে আর্থিক প্রস্তাব ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ইয়াংথাই এনার্জির আর্থিক প্রস্তাবটি মূল্যায়নের জন্য তিনটি সভা করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। গত ২২ জুন দাখিল করা আর্থিক মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদনে ইয়াংথাই এনার্জির প্রস্তাবিত কয়লার দর সাশ্রয়ী উল্লেখ করে তা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

তবে, ২৯ জুন অনুষ্ঠিত আরএনপিএলের বোর্ডসভায় এমডি সেলিম ভূঁইয়া প্রকিউরমেন্ট কর্তৃপক্ষের প্রধানের (হোপ) পদাধিকার ক্ষমতাবলে প্রস্তাবটি পুনরায় মূল্যায়নের জন্য কারিগরি কমিটির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেন। অভিযোগ করা হয়, কমিশনিংয়ের কয়লার দামের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদে কয়লা সরবরাহের প্রস্তাবিত দর বেশি। আরএনপিএলের বোর্ডসভায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির কয়লার দর তুলনা করা হয়। এতে দেখা যায়, ইয়াংথাই এনার্জির প্রস্তাবিত দর প্রতি টনে ১৫ সেন্ট কম হবে। কমিশনিংয়ের জন্য সরবরাহকৃত কয়লার দর আইসিআই-৩ ইনডেক্স অনুসরণ করে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয়। আর নতুন প্রস্তাবে এইচবিএ ইনডেক্স অনুসরণ করা হয়েছে, যা মাসভিত্তিক কয়লার দর প্রকাশ করে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কলাপাড়ায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কমিশনিংয়ের জন্য ইন্দোনেশিয়ার বুকিত আসাম খনি থেকে কয়লা সরবরাহ করেছে ইয়াংথাই এনার্জি। এখন দীর্ঘ মেয়াদে (পাঁচ বছর) কয়লা সরবরাহে দরপত্রের নানা শর্ত পূরণ করে কারিগরিভাবে যোগ্য নির্বাচিত হয়েছে।

আরএনপিএল সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের জন্য ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রথমবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রে বেশ কয়েকটি কোম্পানি শিডিউল কেনে এবং সাতটি কোম্পানিকে শর্ট লিস্টও করা হয়। ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেডও শিডিউল ক্রয় করে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে দরপত্রটি বাতিল হয়ে যায়। পরে গত বছরের ১৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রে পাঁচটি কোম্পানি প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সাবমিট করে এবং ২৯ ফেব্রুয়ারি দরপত্র খোলার সময়সীমা ছিল। ওই দরপত্রেও ইয়াংথাই কারিগরিভাবে যোগ্য বিবেচিত হয়; কিন্তু ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই দরপত্র বাতিল হয়ে যায়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরএনপিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা আমদানির জন্য ৬ নভেম্বর তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করে। ওই দরপত্রে দেশি-বিদেশি অন্তত ২৫টি কোম্পানি অংশ নেয়। তবে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে তৃতীয় দফায় কয়লা আমদানির দরপত্রও বাতিল করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে দরপত্রে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে দফায় দফায় শর্ত শিথিল করার পাশাপাশি যৌথ কোম্পানির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ অনুসারে, গ্রহণযোগ্য দরপত্রে মূল্য সংগতিপূর্ণ হলে তা মূল্যায়ন করে চুক্তি সম্পাদন করার সুযোগ ছিল। এছাড়া পিপিআর বিধিমালা অনুসারে যৌথ কোম্পানির (জয়েন্ট ভেঞ্চার) অংশগ্রহণ অনুমোদন ছিল না। যদিও আনএনপিএলের দরপত্র-সংক্রান্ত কমিটির বক্তব্য, দরপত্রে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

তিন দফা দরপত্র বাতিল এবং মন্ত্রণালয় ও বিপিডিবির তত্ত্বাবধানে কয়েক দফায় শর্ত শিথিল করার পর গত ৩ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ দরপত্রের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল ৬ মার্চ। এরই মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার সরকার কয়লামূল্য নির্ধারণী ইনডেক্স ইন্দোনেশিয়ান কোল ইনডেক্স ৩ (আইসিআই-৩) পরিবর্তে এইচবিএ ইনডেক্স (হারগা বাতুবারা অ্যাক্যুয়ান) অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় ও আগ্রহী দরদাতাদের অনুরোধে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে আলোচনা করে এইচবিএ ইনডেক্স অনুসরণের সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য দরপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা দুই সপ্তাহ বাড়িয়ে করা হয় ২০ মার্চ।

চতুর্থ দফায় আহ্বান করা দরপত্রে সরবরাহকারীর কয়লা রিজার্ভের সক্ষমতার বার্ষিক পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ আগের দরপত্রে একজন সরবরাহকারীর কয়লা রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন থেকে কমিয়ে ১৮ মিলিয়ন টন এবং বার্ষিক গড় উৎপাদন সক্ষমতা ১০ মিলিয়ন টন থেকে কমিয়ে ৭ মিলিয়ন টন করা হয়।

আরএনপিএল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৫০ শতাংশ করে যৌথ মালিকানায় রয়েছে আরপিসিএল ও নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল। ২৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্বালানি সরবরাহে কাজ করতে চায় বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি। যার মধ্যে অন্যতম ইয়াংথাই এনার্জি।

ইয়াংথাই এনার্জির কান্ট্রি ম্যানেজার হো চাও কালবেলাকে বলেন, "ঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে বেশি দরের ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হয়েছে। এছাড়া প্রভাবিত করার চেষ্টাও করা হচ্ছে। এসব কারণে আমরা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানিয়েছি। সেখানে আমরা দর নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিয়েছি।"