সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২

‘উচ্চবিত্তের ফল’ ড্রাগনের দাম পড়ে গেল কী কারণে

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

আগস্ট ১১, ২০২৫, ১২:৪৬ পিএম

‘উচ্চবিত্তের ফল’ ড্রাগনের দাম পড়ে গেল কী কারণে

ছবি- সংগৃহীত

বছর কয়েক আগেও প্রতি কেজি ৫০০-৬০০ টাকায় বিক্রি হওয়া ড্রাগন ফল এখন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাত্র ৮০-১০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে। একসময় ‘উচ্চবিত্তের ফল’ হিসেবে বিবেচিত এই বিদেশী ফলটি এখন সাধারণ ক্রেতাদের নাগালে চলে এসেছে। তবে এই দাম কমার পেছনে উৎপাদনের অভাবনীয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ‘ওভার গ্রোথ হরমোন’ বা ‘টনিকের’ ব্যবহারও বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানা গেছে।

 

ভোক্তাদের অভিজ্ঞতা ও বাজার চিত্র

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি আজহার উদ্দিন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, "বছর কয়েক আগে ড্রাগন কেনার সাহস করতাম না... ৬০০ টাকা দিয়ে এক কেজি ড্রাগন কেনার কথা ভাবতেই পারতাম না। দাম ছিল নাগালের বাইরে। এখন ১০০ টাকার মধ্যে পাই, তাই সন্তানদের জন্য নিয়ে যাই।"

কারওয়ান বাজারে দীর্ঘ দিন ধরে ড্রাগন ফল বিক্রি করে আসা জামালপুরের সুধীর দাশ জানান, "এ ফলের দাম কমতাছে বছরখানেক হইল। আগে ৫০০ টাকা কেজি বিক্রি করতাম। এখন প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করি। কারওয়ান বাজারের অধিকাংশ ড্রাগন ফল আসে ঝিনাইদহ ও রাজশাহী থেকে।"

 

দাম কমার মূল কারণ: উৎপাদন বৃদ্ধি ও হরমোনের ব্যবহার

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে ড্রাগন ফলের উৎপাদন প্রায় ৪০০ শতাংশ বেড়েছে

  • ২০২১-২২ সালে: ১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে ১৩ হাজার ৮৭২ মেট্রিক টন উৎপাদন।

  • ২০২২-২৩ সালে: ২ হাজার ৫৮৮ হেক্টর জমিতে ৫১ হাজার ২৮৭ মেট্রিক টন উৎপাদন।

  • ২০২৩-২৪ সালে: উৎপাদন বেড়ে ৬৮ হাজার ৮১৩ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. ময়নুল হক প্রথম আলোকে বলেন, "ড্রাগন চাষে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ২০২৩ সালের দিকে ব্যাপকভাবে ওভার গ্রোথ হরমোনের ব্যবহার শুরু হয়। ফলে উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। তবে ঝুঁকির কারণে অনেক ক্রেতা ড্রাগন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ফলে ড্রাগনের দামে পতন ঘটে।"

ময়নুল হক আরও জানান, এই ওভার গ্রোথ হরমোন (যা চাষিদের কাছে 'টনিক' নামে পরিচিত) ভারত থেকে চোরাই পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এর ব্যবহার বেশি। মূলত বড় পরিসরের চাষিরাই এটি ব্যবহার করেন।

চাষ পদ্ধতি ও লাভের হিসাব

ময়নুল হক জানান, দেশে দুই পদ্ধতিতে ড্রাগনের চাষ হয়: প্রচলিত পদ্ধতি ও চায়না পদ্ধতি। চায়না পদ্ধতিতে প্রতি বিঘায় ড্রাগনের উৎপাদন হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কেজি। এতে খরচ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও প্রতি বিঘায় গড়ে এক লাখ টাকা লাভ থাকে উৎপাদনকারীর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ড্রাগন উৎপাদনের শীর্ষে আছে ঝিনাইদহ জেলা, যেখানে গত অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩২ হাজার ৭৬৮ মেট্রিক টন। এরপরে রয়েছে যশোর জেলা (১২ হাজার ৫৫৩ মেট্রিক টন) এবং তৃতীয় শীর্ষ জেলা রাজশাহী (৪ হাজার ৪৭৭ মেট্রিক টন)।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার চাষি ছুরত আলী ২০১৭ সাল থেকে ড্রাগন চাষ করছেন। তিনি জানান, আগে এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত ড্রাগন প্রায় ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করতেন, যা এখন কমে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকায় চলে এসেছে। তিনি নিজেও স্বীকার করেন যে 'টনিক' এর ব্যবহার ড্রাগন ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং বাজারে অর্ধেক সবুজ ও অর্ধেক লাল দেখতে ফলগুলোতে এই 'টনিক' ব্যবহার করা হয়েছে।

 

বাংলাদেশে ড্রাগন ফলের আগমন

বাংলাদেশে কীভাবে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনা ‘কৃষি বাতায়ন’-এ বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম থেকে বিভিন্ন জাত এনে বাংলাদেশে ড্রাগনের চাষাবাদ শুরু হয়।

তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মসিউর রহমান জানান, ২০০২-০৩ সালে এই ইনস্টিটিউট ড্রাগনের একটি জাত উদ্ভাবন করে, যা এখন সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক চাষ হয়। এই জাতের ফল মাঝারি, মিষ্টি এবং উৎপাদনও ভালো।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, সংস্থার সাবেক পরিচালক এস এম কামরুজ্জামান ড্রাগন চাষ নিয়ে কাজ করেছিলেন। ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়া কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায় থেকে তাঁকে ভিয়েতনাম থেকে চাষপদ্ধতি শিখে আসতে পাঠানো হয়। তিনি পাঁচটি উন্নত জাতের ৬০টি কাটিং নিয়ে দেশে ফেরেন এবং সফলভাবে চারা করেন। ২০১৩ সালের দিকে ‘মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পে’র অধীনে সারা দেশে ড্রাগনের এক লাখ চারা দিয়ে এক হাজার প্লটে প্রদর্শনী করেন।

কামরুজ্জামান আরও জানান, ২০১১ সালে নাটোরের বড়াই গ্রামের হাদিউল নামের এক কৃষকের জমিতে সরকারিভাবে প্রথম ড্রাগনের চারা রোপণ করা হয়।

 

গবেষকদের মতামত ও সতর্কতা

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মসিউর রহমান জানান, ড্রাগন মূলত উচ্চমূল্যের ফসল। এর দাম কমার পেছনে উৎপাদনের চেয়ে 'টনিকের' ব্যবহারই বড় ভূমিকা পালন করেছে। সীমান্তবর্তী কয়েকটি উপজেলায় এই 'টনিক' দিয়ে ড্রাগন চাষের বিষয়টি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ভোক্তাদের মধ্যে অনীহা তৈরি হয়, যার ফলে দাম কমা শুরু করে।

তিনি ক্রেতাদের মাঝারি আকৃতি ও উপরিভাগের পুরোপুরি লাল রঙের খোসার ড্রাগন কেনার পরামর্শ দেন।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে যে ড্রাগন ফল পাওয়া যায়, তা কতটা নিরাপদ, সে বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য সংস্থাটি একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আপাতত অতিরিক্ত বড় আকারের ড্রাগন ফল এড়িয়ে চলার জন্য ক্রেতাদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।