বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

মিগ-২১ যুদ্ধবিমানকে চিরবিদায় জানাতে যাচ্ছে ভারত

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ২৩, ২০২৫, ০২:১২ পিএম

মিগ-২১ যুদ্ধবিমানকে চিরবিদায় জানাতে যাচ্ছে ভারত

ছবি- সংগৃহীত

 ভারতের বিমান বাহিনীর দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময়ের সঙ্গী, কিংবদন্তী মিগ-২১ যুদ্ধবিমান এবার চিরবিদায় নিতে চলেছে। আগামী ১৯শে সেপ্টেম্বর ২৩ নম্বর 'প্যান্থার্স' স্কোয়াড্রনের অন্তর্ভুক্ত 'মিগ টুয়েন্টি ওয়ান' শেষবারের মতো আকাশে উড়বে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি এমন এক সময়ে এল, যখন বাংলাদেশে একটি চীনা তৈরি অনুরূপ বিমান (এফ-৭) বিধ্বস্ত হয়ে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটলো।

মুক্তিযুদ্ধে মিগ-২১ এর ঐতিহাসিক ভূমিকা:

১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অফিসার ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই (ডাকনাম 'ভূপ') গুয়াহাটি থেকে একটি বিশেষ 'মিশনে' গিয়েছিলেন। তার লেখা বই, 'থান্ডার ওভার ঢাকা'-তে তিনি উল্লেখ করেছেন, গভর্নর্স হাউসের ওপরে তার নেতৃত্বে চারটি মিগ-২১ বিমান দুবার করে চক্কর কেটে মোট ১২৮টি রকেট ফেলেছিল।

সেদিন সকালে ১১টা ২০ মিনিটে ঢাকার সার্কিট হাউসে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলাকালীন হামলা চালানোর নির্দেশ আসে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানানো হয়, টার্গেট সার্কিট হাউস নয়, গভর্নমেন্ট হাউস। ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই কোলে থাকা পর্যটন মানচিত্র দেখেই গভর্নর্স হাউস চিহ্নিত করেন এবং সফলভাবে আক্রমণ পরিচালনা করেন।

মি. বিষ্ণোই তার বইতে লিখেছেন, "স্বাভাবিকভাবেই বেসামরিক সরকারের শিরদাঁড়া সেদিনই ভেঙে গিয়েছিল। দুদিন পরে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি তার ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।" অনেক সমর-বিশেষজ্ঞই মনে করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হিসাবনিকাশ অনেকটাই পাল্টে দিয়েছিল মিগ-২১ এর এই অপারেশন। ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের সময়ে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ ঢাকায় ১৯৭১-এর যুদ্ধে অংশ নেওয়া একটি মিগ-২১ এর প্রতিমূর্তি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

ভারতে মিগ-২১ এর আগমন ও যাত্রা:

১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এক যুগান্তকারী চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারত সরকার বিমান বাহিনীর জন্য যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম বহরটি এনেছিল। সেই দফায় কেনা ১২টি মিগ-২১ ছিল ভারতের প্রথম "অ-পশ্চিমা" যুদ্ধবিমান। ওড়ার জন্য তৈরি বিমান কেনার পাশাপাশি ভারতেই যাতে এই যুদ্ধবিমানগুলি উৎপাদন করা যায়, তার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তাও পেয়েছিল ভারত। মিগ সিরিজের বিমানই ছিল ভারতের হাতে আসা প্রথম সুপারসনিক যুদ্ধবিমান, অর্থাৎ যা শব্দের থেকেও দ্রুত উড়তে পারে।

বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ১৯৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ—সব সামরিক সংঘাতেই মিগ ব্যবহার করেছে ভারতীয় বিমান বাহিনী। এমনকি ২০১৯ সালে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যখন ভারত 'সার্জিকাল স্ট্রাইক' চালিয়েছিল, সেই সময়ে ভারতীয় বৈমানিক অভিনন্দন ভর্তমান একটি মিগ-২১ বাইসন বিমানই ওড়াচ্ছিলেন।

গত ৬০ বছরেরও বেশি সময়ে ভারতীয় বিমান বাহিনী ৮৭০টি মিগ বিমান ব্যবহার করেছে।

দীর্ঘ দুর্ঘটনা এবং 'কফিন-মেকার' তকমা:

অন্তর্ভুক্তির সময়ে কারিগরি দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত থাকলেও, প্রথম থেকেই দুর্ঘটনাতেও পড়েছে মিগ-২১। প্রথম বছর, ১৯৬৩ সালেই দুটি মিগ ক্র্যাশ করেছিল। সরকারি তথ্য সংকলন করে ভারতীয় সংবাদপত্র 'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' লিখেছে যে পাঁচশোরও বেশি মিগ-২১ ভেঙে পড়েছে, এতে ১৭০ জন পাইলটসহ দুশোরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গত ১৫ বছরেই ২০টি মিগ বিমান ভেঙে পড়েছে। এত বেশি দুর্ঘটনার কারণে মিগ-২১-কে কখনও 'কফিন-মেকার' বা 'উইডো-মেকার' বলা হয়।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস সুজান, যিনি নিজে ১২-১৩ বছর মিগ-২১ যুদ্ধবিমান উড়িয়েছেন, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। মিগ অনেক বছর আগেই তার কার্যকাল শেষ করেছে।"

তিনি মিগ-এর কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন:

  • মিগ-এ একটি মাত্র ইঞ্জিন থাকে।

  • এর পে লোড ক্যাপাসিটিও কম—জ্বালানি এবং অস্ত্র বহনের ক্ষমতা কম।

  • মিগের রেঞ্জও যেমন কম, তেমনই আকাশে ওড়ার সময়েই জ্বালানি ভরার ব্যবস্থাও নেই।

সুজানের মতে, "যে কোনও আধুনিক বিমানবাহিনীতে মিগ-২১ এখন আর আদর্শ যুদ্ধবিমান নয়।" তিনি মনে করেন, উন্নতমানের যন্ত্রাংশ এবং ভাল অটো-পাইলট ব্যবস্থা থাকলে হয়তো এত দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।

বিকল্প হিসাবে 'তেজস' এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা:

মিগ-২১ এর বিকল্প হিসাবে ভারতীয় বিমান বাহিনী নিয়ে এসেছে লাইট কম্ব্যাট এয়ারক্র্যাফ্ট 'তেজস'। তবে 'তেজস' পরিকল্পনা রূপায়িত হতে বহু বছর দেরি হয়েছে। 'ডিফেন্স ওয়াচ' পোর্টাল জানাচ্ছে, 'তেজস' তৈরি করে যে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (HAL), তাদের ২০২৭-২৮ সালের মধ্যে ৮৩টি বিমান দেওয়ার কথা। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিই-এর ইঞ্জিন পাওয়া নিয়ে বড় সমস্যা থাকায় তেজসের পরিকল্পনা অনেক বছর পিছিয়ে রয়েছে।

অবশেষে সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখে মিগ-২১ ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে। মি. সুজানের কথায়, "আমাদের সতীর্থরা প্রায় সকলেই মিগ টুয়েন্টি ওয়ান উড়িয়েই কেরিয়ার শুরু করেছি...মিগের বহরে সাধারণত আমরা পাঁচ-ছয় বছর থাকতাম। এরপরে আমাদের উন্নততর বিমান, যেমন মিরাজ টু থাউজ্যান্ড বা মিগ টুয়েন্টি নাইন ইত্যাদিতে পাঠানো হত।" তিনি আরও বলেন, "কোনও বিমানবহর যখন বাহিনী থেকে অবসর নেয়, তার সঙ্গে জড়িত থাকে অনেক সুখস্মৃতি। তবে বাস্তবের দিক থেকে বিচার করলে মিগ টুয়েন্টি ওয়ানকে অবশেষে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্তটা সঠিক।"

সুত্রঃ বিবিসি বাংলা