জুলাই ২৪, ২০২৫, ০৭:১৮ পিএম
বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা, যা পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়, দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত ছিল। এই ধারার অপব্যবহার করে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করার অভিযোগ ছিল, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়ে দাঁড়াত। সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় এবং নাগরিক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনার জন্য সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সম্প্রতি সরকার ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে নতুন দুটি কঠোর শর্ত আরোপ করেছে, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতাকে আরও সুনির্দিষ্ট করবে এবং সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা করবে।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ঘোষণা করেছেন যে, এখন থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় কাউকে গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে কঠোর দুটি শর্ত পালন করতে হবে। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা জানান। এই পদক্ষেপ ৫৪ ধারার অপব্যবহার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, "আগে সন্দেহের অবকাশে ৫৪ ধারায় ইচ্ছামতো গ্রেপ্তার করা হতো। সেখানে আমরা ফৌজদারি কার্যবিধিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছি। যদি সন্দেহে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে যিনি গ্রেপ্তার করবেন, তাকে নিশ্চিত হতে হবে যে তার সামনে অপরাধ ঘটেছে এবং তার বিশ্বাস করার সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে হবে যে ওই ব্যক্তিই অপরাধ করেছেন।" তিনি আরও যোগ করেন, "সেই কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হলো।"
দ্বিতীয় শর্ত হিসেবে তিনি বলেন, "নন-কগনিজেবল (অজ্ঞাতনামা) অপরাধের ক্ষেত্রেও একই কাজ করতে হবে এবং কর্মকর্তাকে সন্তুষ্ট হতে হবে যে কাজটি না করলে লোকটা পালিয়ে যেতে পারে। এই দুটি শর্ত পূরণ হলে তবেই ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে।"
আইন উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত ছিল গ্রেপ্তারের বিষয়ে যাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকে এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির যেন অধিকার থাকে। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের দুটি রায় ছিল। এই রায়ের আলোকে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন, সুপ্রিম কোর্ট, এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে এই সংশোধনীগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে।
নতুন সংশোধনীগুলোর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো:
-
পরিচয় নিশ্চিতকরণ: সংশোধনী কার্যকর হওয়ার পর থেকে যে পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তার করবেন, তার পরিষ্কার পরিচয় থাকতে হবে। তার ইউনিফর্মে নেমপ্লেট থাকতে হবে এবং আইডি কার্ড থাকতে হবে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির চাহিদামাত্র পুলিশ কর্মকর্তার আইডি কার্ড দেখানো বাধ্যতামূলক।
-
পরিবারকে অবহিতকরণ: গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে যখন থানায় নিয়ে আসা হবে, যত দ্রুত সম্ভব তার পরিবার, বন্ধু, কিংবা আইনজীবীকে যোগাযোগ করে জানাতে হবে। এই কাজে কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার বেশি সময় নেওয়া যাবে না।
-
চিকিৎসা সুবিধা: গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির শরীরে যদি কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকে বা সেই ব্যক্তি যদি অসুস্থবোধ করেন, তাহলে অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা দিতে হবে।
-
গ্রেপ্তার মেমোরেন্ডাম: প্রতিটি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে একটি 'মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্ট' রাখতে হবে, যেখানে বিস্তারিত তথ্য যেমন - কাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কী অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কোন আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এবং কে গ্রেপ্তার করেছে - সবকিছু সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
-
তথ্য সংরক্ষণ ও আদান-প্রদান: আইন উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, "আগে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিভিন্ন এজেন্সি গ্রেপ্তার করতো। গ্রেপ্তার করে বলতো 'আমরা জানি না'। র্যাব গ্রেপ্তার করে বলতো 'পুলিশ জানে', পুলিশ গ্রেপ্তার করে অন্য আরেক সংস্থার নাম বলতো। আমরা আইনে বলেছি - যেই সংস্থাই গ্রেপ্তার করুক তাদের সংশ্লিষ্ট অফিসে গ্রেপ্তার ব্যক্তির সব তথ্য সেখানে থাকতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠাতে হবে।" তিনি আরও জানান যে, নিয়মিতভাবে প্রত্যেক থানায়, জেলা সুপারের কার্যালয়ে এবং পুলিশ হেড কোয়ার্টারে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের তালিকা থাকবে, যা বাধ্যতামূলক।
আপনার মতামত লিখুন: