জুলাই ২৭, ২০২৫, ১২:৩৫ পিএম
ইসলামের এক অন্যতম সৌন্দর্য হলো সব মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক তৈরি করে দেওয়া এবং একজন অপরজনের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া। মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট থাকেই, আর এমন পরিস্থিতিতে কেউ যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে জীবন গতিশীল হয়ে ওঠে।
এখানে সাহায্য মানে কেবল টাকাপয়সা দেওয়া নয়, সাহায্য অনেকভাবেই হতে পারে, এমনকি কথা দিয়েও সাহায্য করা যায়। কোনো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে যদি বলেন, ‘দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে বিপদমুক্ত করুন’, এটাও কিন্তু এক ধরনের সাহায্য। কোনো ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির দাতাকে গিয়ে যদি অনুরোধ করেন, ‘তাকে আর কয়েকটা দিন সময় দিন, সে ঋণের টাকা জোগাড় করতে পারেনি’, এটাও তাকে সাহায্য করবে।
সাহায্যের গুরুত্ব ও ফজিলত
নবীজি (সা.) পারস্পরিক সাহায্যের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন: "যে লোক কোনো মুসলমানের দুনিয়ার বিপদ–আপদের মধ্যে একটি বিপদও দূর করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার পরকালের বিপদ–আপদের কোনো একটি বিপদ দূর করে দেবেন। যে লোক দুনিয়াতে অন্য কারও অভাব দূর করে দেয়, তার দুনিয়া ও আখিরাতের অসুবিধাগুলোকে আল্লাহ তাআলা সহজ করে দেবেন। যে লোক দুনিয়ায় কোনো মুসলিমের দোষত্রুটিকে গোপন রাখে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন। যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য-সহযোগিতায় নিয়োজিত থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তাআলাও তার সাহায্য-সহযোগিতায় নিয়োজিত থাকেন।" (জামে তিরমিজি, হাদিস: ১৯৩০)
এই হাদিস মুসলিমদের মধ্যে সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব তুলে ধরে।
নবীজির (সা.) অলৌকিক সাহায্য: জাবির (রা.) এর ঘটনা
নবীজি (সা.) কীভাবে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন তার একটি চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যায় হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) এর ঘটনায়। হজরত জাবির (রা.) এক ইহুদির কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন এবং কথা ছিল খেজুর তোলার মৌসুমে ঋণ ফেরত দেবেন। রুমা নামের জায়গায় তাঁর ছোট্ট একটা খেজুরের বাগান ছিল, যেখানে খুব বেশি খেজুর ধরত না। এত কম খেজুর দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল।
এজন্য তিনি ইহুদির কাছে বলে-কয়ে এক বছর সময় বাড়িয়ে নেন। কিন্তু পরের বছরও তিনি সুবিধা করতে পারেননি। ঋণ পরিশোধ করলে তার হাত একদম খালি হয়ে যেত। তিনি ইহুদিকে আরও এক বছর সময় দেওয়ার অনুরোধ করলেন, কিন্তু ইহুদি আর ছাড় দিতে রাজি ছিল না।
নবীজি (সা.) এ খবর শুনে সাহাবিদের বললেন, "চলো, জাবিরের জন্য ইহুদির কাছ থেকে সময় চেয়ে নিই।"
সাহাবিদের নিয়ে নবীজি (সা.) জাবির (রা.)-এর বাগানে এলেন। ইহুদির সঙ্গে তার কথাবার্তা হলো। ইহুদি বলল, ‘আবুল কাসেম, আমি তাকে আর সময় দেব না।’ (নবীজির (সা.) প্রথম সন্তানের নাম ছিল কাসেম, যিনি অল্প বয়সে ইন্তেকাল করেন। এ জন্য আরব দেশের রীতি অনুযায়ী তাকে ‘আবুল কাসেম’ বা ‘কাসেমের বাবা’ বলা হতো।)
নবীজি (সা.) একবার বাগানটাকে ঘুরে দেখলেন, এরপর আবার ইহুদিকে অনুরোধ করলেন। কিন্তু ইহুদি কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। জাবির (রা.) নবীজিকে (সা.) কিছু খেজুর খেতে দিলেন। নবীজি (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "জাবির, তোমার ছাপরা ঘরটা কোন দিকে?" জাবির (রা.) দেখিয়ে দিলে নবীজি (সা.) বললেন, "আমার জন্য বিছানা বিছিয়ে দাও।" জাবির (রা.) তা-ই করলেন। নবীজি (সা.) সেখানে ঘুমালেন। ঘুম থেকে ওঠার পর জাবির (রা.) আবার খেজুর সামনে রাখলেন। তিনি সেগুলো খেলেন। এরপর আবার ইহুদিকে ছাড় দিতে বললেন, কিন্তু কিছুতেই ইহুদির মন গলল না।
নবীজি (সা.) আবার বাগানটাকে ঘুরে দেখলেন। তারপর জাবির (রা.)-কে বললেন, "তুমি তার পাওনা খেজুর দিতে থাকো।" এই বলে তিনি খেজুর পাড়ার স্থানে বসলেন। জাবির (রা.) ইহুদির প্রাপ্য সব খেজুর দিয়ে দেওয়ার পরও দেখলেন অনেক খেজুর বেঁচে আছে। আসলে এটি ছিল নবীজির (সা.) একটি মোজেজা। জাবির (রা.) নবীজিকে (সা.) সুসংবাদ দিলেন। নবীজি (সা.) তখন বললেন, "আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আমি আল্লাহর রসুল।" (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৪৪৩)
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, সাহায্য কেবল জাগতিক নয়, বরং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় অলৌকিকভাবেও আসতে পারে, যখন বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে। ইসলামে পারস্পরিক এই সহযোগিতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা মুসলিম সমাজকে এক সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে।
মওলবি আশরাফ: আলেম, লেখক ও অনুবাদক
আপনার মতামত লিখুন: