জুলাই ৩১, ২০২৫, ০৩:৩৭ পিএম
নবী ইউসুফ (আ.) ছিলেন নবী ইয়াকুব (আ.)-এর প্রিয় পুত্র। তাঁর নামে কোরআনে স্বতন্ত্র একটি সুরা আছে, যেখানে তাঁর জীবনকথার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ইয়াকুব (আ.)-এর ১২ ছেলের মধ্যে ইউসুফ (আ.) ও তাঁর ছোট ভাই বেনিয়ামিন ছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী রাহিলের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী। ইউসুফ (আ.) ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন এবং বাবা তাঁকে অন্যদের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, যা তাঁর ভাইদের মধ্যে ঈর্ষা সৃষ্টি করেছিল।
বিস্ময়কর স্বপ্ন ও পারিবারিক ঈর্ষা
ইউসুফ (আ.) শৈশবে একটি বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখেন, যা ছিল তাঁর নবী হওয়ার শুভবার্তা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, "ইউসুফ তার বাবাকে বলল, হে আব্বাজান, আমি (স্বপ্নে) দেখেছি, ১১টি তারকা আর সূর্য ও চন্দ্র, তারা আমাকে সিজদা করছে।" (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪)। ইউসুফের প্রতি বাবার এই অতিরিক্ত ভালোবাসা অন্য ভাইয়েরা মেনে নিতে পারতেন না। তাঁরা হিংসায় জ্বলতেন। ইয়াকুব (আ.) তাঁদের মনোভাব বুঝতে পারতেন, তাই ইউসুফকে চোখে চোখে রাখতেন। একদিন ভাইয়েরা ইউসুফ (আ.)-কে জঙ্গলের এক কুয়ায় ফেলে দেন এবং বাড়ি ফিরে বাবাকে ইউসুফের মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ দেন। ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন বাবা ইয়াকুব (আ.)। (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ১৮)
মিসরে আগমন ও প্রাসাদ জীবন
সেই কুয়ার পথ ধরে ফিরছিল একটি কাফেলা। কুয়া থেকে বালতি ওঠাতেই তারা ফুটফুটে সুন্দর ইউসুফ (আ.)-কে দেখতে পায়। তারা তাঁকে মিসরে বিক্রি করে দেয়। মিসরের মন্ত্রী কিতফির তাঁকে কিনে নেন এবং তাঁর প্রাসাদে তিনি বড় হতে থাকেন। একসময় যৌবনে পা রাখেন ইউসুফ (আ.)। রূপ ও সৌন্দর্যে ভরপুর ছিল তাঁর যৌবন, চেহারা ছিল চন্দ্র ও সূর্যের মতো দীপ্তিমান। নিষ্কলুষতা ও লজ্জার আধিক্য সোনায় সোহাগার মতো কাজ করছিল তাঁর মধ্যে। মাধুর্য ও কমনীয়তার মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি।
জুলেখার প্রলোভন ও ইউসুফ (আ.)-এর সততা
মিসরের মন্ত্রীর স্ত্রী জুলেখা। তিনি ইউসুফের রূপে বরাবরই বিমোহিত ছিলেন এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। নিজের মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিনি ইউসুফ (আ.)-কে খারাপ কাজের প্রতি আহ্বান করেন, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। জুলেখা ইউসুফকে বশে আনতে নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকেন, এমনকি জাদুও করেছিলেন, তবে এতে কাজ হয়নি।
একদিন ইউসুফকে ঘরে একা পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেন জুলেখা এবং পাপের দিকে আহ্বান করেন। আল্লাহর ভয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। জুলেখার জোরাজুরিতে উপায় না পেয়ে বন্ধ দরজার দিকে দৌড় দিলেন ইউসুফ। আশ্চর্যজনকভাবে দরজা খুলে গেল! দরজার ওপাশে আজিজে মিসর কিতফির ও জুলেখার চাচাতো ভাই দাঁড়ানো ছিলেন। জুলেখা ইউসুফের ওপর অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সত্যতা যাচাইয়ে ছেঁড়া জামার প্রমাণ পেশ করা হলো। জামার পেছন দিক ছেঁড়া থাকায় জুলেখা অপরাধী সাব্যস্ত হলেন।
এই ঘটনা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “সে (ইউসুফ) বলল, সে-ই আমার থেকে অসৎ কর্ম কামনা করেছে। তখন নারীর পরিবারের এক সাক্ষী সাক্ষ্য দিল, যদি তার জামা সম্মুখ দিক থেকে ছেঁড়া হয়ে থাকে, তাহলে নারী সত্য বলেছে আর সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। আর যদি তার জামা পেছন থেকে ছেঁড়া হয়ে থাকে, তাহলে নারী মিথ্যা বলেছে আর সে সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। স্বামী যখন ইউসুফের জামাটি পেছন থেকে ছেঁড়া দেখতে পেলেন, তখন তিনি বললেন, এসব হলো তোমাদের নারীদের ছলনা, তোমাদের কূটকৌশল বড়ই কঠিন।” (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ২৬-২৮)। সত্য বুঝতে পারার পরও জুলেখার সম্মান বাঁচাতে তাঁর স্বামী কিতফির ইউসুফ (আ.)-কে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন।
কারাগার থেকে ক্ষমতা: স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও রাজকীয় দায়িত্ব
জেলখানায় বন্দিরা ইউসুফ (আ.)-কে বেশ সমীহ করতেন। ইউসুফ (আ.) তাঁদের আল্লাহর পথে দাওয়াত দেন। সে সময় মিসরের বাদশাহ এক স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের অর্থপূর্ণ ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারছিলেন না। জেলবন্দি ইউসুফ (আ.) সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বাদশাহ বেজায় খুশি হন এবং তাঁকে মুক্তি দেন। পরে তিনি মিসরের খাদ্যভাণ্ডার ও ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পান।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “রাজা বলল, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তাকে আমার জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে নেব। অতঃপর সে (ইউসুফ) যখন তার সঙ্গে কথা বলল, তখন রাজা বলল, আজ তুমি আমাদের কাছে খুবই মর্যাদাশীল ও বিশ্বস্ত হিসেবে পরিগণিত। সে (ইউসুফ) বলল, ‘আমাকে দেশের ধনভাণ্ডারের দায়িত্ব দেন, আমি উত্তম রক্ষক ও যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। এভাবে আমি ইউসুফকে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম। দেশের যেখানে ইচ্ছা সে নিজের স্থান করে নিতে পারত। আমি যাকে চাই আমার রহমত দিয়ে ধন্য করি, আমি সৎকর্মশীলদের কর্মফল কক্ষনো বিনষ্ট করি না।’” (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৫৪-৫৬)
জুলেখার সাথে সম্পর্ক: প্রচলিত ভুল ধারণা
অনেকের ধারণা, ইউসুফ (আ.) জুলেখার সঙ্গে প্রেম করেছেন, তবে এটি সত্য নয়। এটি একটি প্রচলিত ভুল। জুলেখার ছিল একপক্ষীয় প্রেম। জুলেখার সঙ্গে ইউসুফ (আ.)-এর বিয়ে হয়েছিল কি না, এ বিষয়ে কোরআন-হাদিস থেকে স্পষ্ট কিছুই জানা যায়নি। তবে কোনো কোনো মুফাসসির উল্লেখ করেছেন, স্বামী কিতফিরের মৃত্যুর পর এবং তাওবা করার পর ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে জুলেখার বিয়ে হয়েছিল।(তাফসিরে ইবনে আবি হাতিম, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-৩৯০)