শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

নাছিমার লাল শাড়িতে মায়ের বুকভাঙা আর্তনাদ, স্মৃতি অমলিন

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

জুলাই ২৪, ২০২৫, ০৭:০৮ পিএম

নাছিমার লাল শাড়িতে মায়ের বুকভাঙা আর্তনাদ, স্মৃতি অমলিন

একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা কীভাবে একটি পরিবারের জীবনে শোকের এক গভীর কালো ছায়া ফেলে দিতে পারে, তার এক করুণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে নোয়াখালীর নাছিমা আক্তারের ঘটনা। গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডিতে এক মর্মান্তিক ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন তিনি। তার অকাল মৃত্যু শুধু পরিবারকেই নয়, পুরো এলাকাজুড়ে শোকের আবহ তৈরি করেছে। তার প্রিয় লাল জামদানি শাড়িটি এখন তার মায়ের কাছে কেবল একটি বস্ত্র নয়, বরং মেয়ের শেষ স্মৃতিচিহ্ন, যা আঁকড়ে ধরে প্রতিদিনই মেয়ের জন্য অঝোরে কাঁদেন মা ছালেহা বেগম।

এক ঝলমলে লাল জামদানি শাড়ি—যা ছিল নোয়াখালীর নাছিমা আক্তার (২৪) এর সবচেয়ে প্রিয়। সেই শাড়িতেই তিনি সেজে উঠতেন নববধূ রূপে, তুলতেন অসংখ্য ছবি। আজ সেই শাড়িই তার মায়ের কাছে শুধুই এক হৃদয়বিদারক স্মৃতি। মেয়ের শেষ স্মৃতিচিহ্নটি আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদেন মা ছালেহা বেগম, তার চোখেমুখে অপূরণীয় ক্ষতির বেদনা।




 

নাছিমা আক্তার নোয়াখালীর সুধারাম মডেল থানার মাইজদী বাজার এলাকার মৃত ইউছুপ মিয়ার মেয়ে। স্বল্প সময়ের জন্য তিনি ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন। তার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল এবং তার ইচ্ছা ছিল, চার বোন মিলে একই রঙের শাড়ি পরে তার বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। পুরো বাড়িতে আলোকসজ্জা হবে—এমন স্বপ্নও দেখতেন তিনি। কিন্তু সেই ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেল, মেহেদী রাঙানো হলো না নাছিমার হাত।

জানা গেছে, মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিল গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে, রাজধানীর ধানমন্ডি ১ নম্বর সড়কের একটি ১০ তলা ভবনের ছাদে। সেখানে নাছিমা ও তার ভাতিজা আইমান উদ্দিন (২৩) অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ করেই আকাশে একটি হেলিকপ্টার ও ড্রোন ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাদে থাকা দুইজনই গুলিবিদ্ধ হন। একটি গুলি আইমানের বুক ভেদ করে পাশে থাকা নাছিমার মুখে প্রবেশ করে এবং গলায় আটকে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় তাৎক্ষণিকভাবে আহত দুইজনকে পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের ভর্তি করা হয়েছিল। পরদিন বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় নাছিমা আক্তারের।

 

নাছিমার ভাবি ও গুলিবিদ্ধ আইমানের মা রেহানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, "আমি বাসায় ছিলাম। আইমান তার ফুফুসহ ছাদে দেখতে গিয়েছিল। গুলিবর্ষণের ঘটনার খবর শুনেই আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি—চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করি। চারপাশের মানুষ ছুটে আসে, তারপর তাদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকরা তখন বলছিলেন, আমার ছেলে ও ননদ বাঁচবে না। মুহূর্তেই যেন সব অন্ধকার হয়ে আসে আমার সামনে। চারদিকে তখন ইন্টারনেট বন্ধ, কোথাও যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমি একা, পুরোপুরি অসহায়। অনেক চেষ্টা, দোয়া ও ডাক্তারদের প্রচেষ্টায় আমার ছেলেকে শেষমেশ বাঁচানো গেল—কিন্তু আমার ননদকে আর ফিরিয়ে আনা গেল না। সেই ক্ষত কোনো দিন মুছে যাবে না।"
 

কান্নাভেজা কণ্ঠে নাছিমার বোন কোহিনুর বেগম ঢাকা পোস্টকে জানান, "নাছিমা খুব ভালোবাসতো সাজতে। লাল জামদানি শাড়ি তার প্রিয় ছিল—পরত, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত। তার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, সে নিজেই বলেছিল— বিয়েতে পুরো বাড়ি আলোয় ঝলমল করবে, আমরা সব বোন একই রঙের শাড়ি পরবো। কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এখনো বিশ্বাস করতে পারি না সে নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে। আবার পুরো বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজি—কিন্তু ওকে আর পাই না। আমার বোনকে যারা এমন নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে, আমরা তাদের কঠিন শাস্তি চাই। আমার বোনের প্রাণের যেন মূল্য থাকে।"

নাছিমার ভাই হেলাল উদ্দিন সোলায়মান, যিনি স্পেন প্রবাসী, ঢাকা পোস্টকে বলেন, "তখন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি নাছিমাকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়, যেখানে এক রাত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পরদিন বিকেলে শহীদ হয় নাছিমা। আমার ছেলে আইমান ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। পরে ৫ আগস্ট ছাড়পত্র পেয়ে বাসায় ফেরে। তার বুকে এখনো গুলির ক্ষত রয়েছে। মানসিক ট্রমা রয়ে গেছে।"

 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাছিমার মা ছালেহা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, "আমার সাত সন্তানের মধ্যে নাছিমা ছিল সবার ছোট। চার মেয়ের মধ্যে সে আমার শেষ আশ্রয়, আমার চোখের মনি। সব সময় আমার কাছেই থাকতো, আমি বলতাম—ওই তো আমার হাতের লাঠি। নাছিমা সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকত। বাচ্চাদের ভীষণ ভালোবাসত, আর আশপাশের বাচ্চারাও ওকে খুব পছন্দ করত। কিছুদিনের জন্য ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল আমার সোনা মেয়েটা। কে জানতো, সে আর ফিরবে না। লাশ হয়ে ফিরেছে আমার বুক ভেঙে। ওর শাড়িগুলো, সাজসজ্জার জিনিসগুলো—সবই এখন স্মৃতি হয়ে আছে আমার সামনে। ওর লাল টুকটুকে জামদানি শাড়ি দেখলেই বুক হাহাকার করে ওঠে, চোখ ভিজে যায়। আমি আল্লাহর কাছে শুধু এই দোয়া করি—আমার মেয়েকে যেন জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে রাখেন।"

এই ঘটনাটি গত বছর (২০২৪ সালের ১৯ জুলাই) ঘটেছিল এবং সে সময়ের জাতীয় পরিস্থিতি (জুলাই অভ্যুত্থান) ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তথ্য আদান-প্রদানে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, যা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে আরও অসহায় করে তুলেছিল।