আগস্ট ১১, ২০২৫, ০৪:৪৮ পিএম
চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জ করে ৪ হাজার শিক্ষার্থী নতুন করে পাস করেছে। শুধু তাই নয়, খাতা চ্যালেঞ্জের পর পুনর্নিরীক্ষণে ফেল করা সাতজন শিক্ষার্থী সরাসরি জিপিএ ৫ পেয়েছে। আর অন্যান্য গ্রেড থেকে নতুন করে জিপিএ ৫ পেয়েছে ১০৪৫ জন। গতকাল রোববার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। ১১টি সাধারণ বোর্ডের প্রকাশিত পুনর্নিরীক্ষণের ফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলতি বছরে খাতা পুনর্নিরীক্ষার সংখ্যা গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। গত বছরের চেয়ে এবার আবেদন বেড়েছে ৭১ শতাংশ। ফল পরিবর্তনের এমন চিত্রকে সংশ্লিষ্টরা পরীক্ষকদের ‘চরম গাফিলতি’ হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে বোঝা যায় পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
সব বোর্ডের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণে এবার মোট ১৫ হাজার ২৪৩ জন শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৮৭৫ এবং ২০২৩ সালে ১১ হাজার ৩৬২। এক বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা বেড়েছে ৬ হাজার ৩৬৮ জন বা ৭১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।
১১টি শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, পুনর্নিরীক্ষণে মোট ৩ হাজার ৯২৫ জন শিক্ষার্থী ফেল থেকে পাস করেছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কারিগরি বোর্ড, যেখানে ২ হাজার ৬৫৪ জন ফেল থেকে পাস করেছে। এরপর মাদ্রাসা বোর্ডে ৯৯১ জন, ঢাকা বোর্ডে ২৯৩, ময়মনসিংহে ২১০, কুমিল্লায় ১৯০, রাজশাহীতে ৪৮, যশোরে ১৮৭, বরিশালে ২৬, চট্টগ্রামে ৬৪, সিলেটে ৩০ ও দিনাজপুর বোর্ডে ৯৯ জন।
ফেল এসেছিল এমন সাতজন শিক্ষার্থী খাতা চ্যালেঞ্জ করে নতুন করে জিপিএ ৫ পেয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও কারিগরি বোর্ডে ৩ জন করে এবং ময়মনসিংহে ১ জন। নতুন করে জিপিএ ৫ পেয়েছে মোট ১ হাজার ৪৫ জন। এর মধ্যে ঢাকা বোর্ডে ২৮৬ জন, মাদ্রাসা বোর্ডে ১৩৯, ময়মনসিংহে ১৬৬, কুমিল্লায় ৬৭, রাজশাহীতে ৩৫, যশোরে ২৭১, বরিশালে ২৬, চট্টগ্রামে ৬৫, সিলেটে ২২, দিনাজপুরে ৫৭ এবং কারিগরি বোর্ডে ১২ জন।
শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের কর্মকর্তারা জানান, পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন জমা পড়া উত্তরপত্রের চারটি দিক দেখা হয়:
-
উত্তরপত্রের সব প্রশ্নের সঠিকভাবে নম্বর দেওয়া হয়েছে কি না।
-
প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক রয়েছে কি না।
-
প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে ওঠানো হয়েছে কি না।
-
প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটের বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে কি না।
এসব পরীক্ষা করেই পুনর্নিরীক্ষার ফল দেওয়া হয়। তবে পরীক্ষক কোনো প্রশ্নের উত্তরের জন্য যে নম্বর দিয়ে থাকেন সেটি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। যেমন- পরীক্ষক একটি প্রশ্নের উত্তরের জন্য ৬ নম্বর দিয়েছেন, সেটি ভুলবশত ৩ নম্বর হিসেবে গণনা করা হলো, এ ধরনের ভুল সংশোধন করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবে যেন পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা বিবেচনায় রাখা হয়। কিন্তু এই ৬ নম্বরের জায়গায় ৮ নম্বর দেওয়ার সুযোগ নেই।
চ্যালেঞ্জ হওয়া খাতাগুলো তৃতীয় শিক্ষকদের দিয়ে পুনর্নিরীক্ষণ হয়। পুনর্নিরীক্ষণের সময় পরীক্ষক কী কী ভুল করেছেন, তা মন্তব্যের জায়গায় লিখতে বলা হয়। তৃতীয় শিক্ষকদের এসব মন্তব্য ধরে ধরে অভিযুক্ত শিক্ষকদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। পরীক্ষক প্রশ্নের যে নম্বর দিয়েছেন তা পরিবর্তন করা যাবে না।
প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ফলে পরিবর্তন আসার পেছনে দ্রুততম সময়ে খাতা মূল্যায়ন, অন্যকে দিয়ে খাতা মূল্যায়ন, ভালো পরীক্ষক না পাওয়া, খাতা মূল্যায়নে সম্মানী কম হওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, পরীক্ষকরা খাতা মূল্যায়নের পর নম্বরের যোগফলে ভুল করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে উত্তরের নম্বর ঠিকমতো যোগ করা হয় না, এমনকি ওএমআর ফরমে বৃত্ত ভরাট করতে গিয়ে অনেকে ভুল করছেন। এ বিষয়ে পরীক্ষকরা জানান, ভুলের অন্যতম কারণ পরীক্ষা শেষে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশের সময় বেঁধে দেওয়া। একজন পরীক্ষককে ১০-১২ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এতে তিনি খাতা মূল্যায়নে তাড়াহুড়া করেন। ফলে ভুলের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
এ বিষয়ে আন্তঃবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, "চলতি বছর খাতা পুনর্নিরীক্ষণের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক ছিলাম, যাতে কোনো শিক্ষার্থী দ্বিতীয়বার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।" পরীক্ষকদের গাফিলতির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, "এটা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তবে এবার শিক্ষার্থী বা অন্য কাউকে দিয়ে খাতা মূল্যায়নের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতিতে ছিলাম।"
মৌলিক বিষয়ে বেশি ভুল: আন্তঃশিক্ষা বোর্ড বলছে, ভুলের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তির মতো কমন বিষয়ে পরীক্ষকরা বেশি ভুল করছেন। এজন্য পরীক্ষক সংকট ও স্বল্প সময়ে খাতা মূল্যায়নই দায়ী। যেমন চলতি বছর গণিতে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে। শুধু ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ৪২ হাজার ৯৩৬ জন গণিতের খাতা চ্যালেঞ্জ করেছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কামাল হায়দার বলেন, "সব বিভাগের সব শিক্ষার্থীর বাংলা, ইংরেজি, গণিত, আইসিটির মতো বিষয় বাধ্যতামূলক। তার মানে এসব বিষয়ে পরীক্ষার্থী বেশি, খাতা বেশি, সে তুলনায় যোগ্য পরীক্ষক কম। বাধ্য হয়ে একজন পরীক্ষককে ৫০০ থেকে ৬০০ পর্যন্ত খাতা মূল্যায়নের জন্য দেওয়া হয়। সময় দেওয়া হয় মাত্র ১০ থেকে ১২ দিন। এতে তারা তাড়াহুড়া করেন এবং ভুলগুলো বেশি হয়। তার পরও কোনো ভুল ক্ষমার যোগ্য নয়। খাতা মূল্যায়নে পরীক্ষকদের সময় ৪-৫ দিন বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে।"
খাতা মূল্যায়নে অবহেলা বা গাফিলতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দিয়ে থাকে বোর্ড। সাধারণত অভিযুক্ত বেশিরভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অপরাধের মাত্রা বেশি হলে, তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয়কে বোর্ড সুপারিশ করে। একজন পরীক্ষককে শাস্তির দেওয়ার আগে তার বিগত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। অপরাধের ধরনের ধারাবাহিকতা থাকলে তাকে স্থায়ী কালো তালিকাভুক্ত, কম হলে এক থেকে পাঁচ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ভুলের প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করার সুপারিশ করতে পারে।
এ ব্যাপারে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, পরীক্ষা আইনের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া যায়। তবে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কালো তালিকাভুক্ত বেশি করা হয়। বোর্ড কোনো শাস্তি দিতে পারে না। তাই অপরাধের মাত্রা বেশি হলে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়ে থাকে।
শিক্ষা বোর্ড জানিয়েছে, যারা বড় ধরনের ভুল করেছে, তাদের চিহ্নিত করা হবে। সে প্রক্রিয়া হলো চ্যালেঞ্জ হওয়া খাতাগুলো তৃতীয় শিক্ষককে দিয়ে পুনর্নিরীক্ষণের সময় প্রথম পরীক্ষক কী কী ভুল করেছেন, তা মন্তব্যের জায়গায় লিখতে বলা হয়। তৃতীয় শিক্ষকদের এসব মন্তব্য ধরে ধরে অভিযুক্ত শিক্ষকদের চিহ্নিত করা হবে।