জুলাই ২৫, ২০২৫, ০৪:১৪ পিএম
সাম্প্রতিক বিভিন্ন দুর্ঘটনায়, বিশেষ করে ঢাকার উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের মতো ঘটনায়, অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব রোগীদের চিকিৎসায় প্রায়শই প্রচুর পরিমাণে রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে, যা হাসপাতাল এবং রোগীর স্বজনদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। অনেকেই জানতে চান, কেন আগুনে পোড়া রোগীদের এতো বেশি রক্ত বা প্লাজমার প্রয়োজন হয়। এই প্রশ্নের উত্তর এবং এর পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণগুলো জানতে চলুন জেনে নিই বিশেষজ্ঞদের মতামত।
আগুনে পোড়া আঘাত একটি অত্যন্ত গুরুতর অবস্থা, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে শরীরে জটিল শারীরিক পরিবর্তন ঘটে, যার অন্যতম প্রধান পরিণতি হলো প্রচুর পরিমাণে রক্ত ও তরল পদার্থের ক্ষয়। কেন এই রোগীদের এত বেশি রক্তের প্রয়োজন হয়, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
১. প্লাজমা ও তরল ক্ষয়: আগুনে পোড়ার কারণে ত্বকের রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ছিদ্রযুক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে রক্তরস (প্লাজমা) দ্রুত শরীরের কোষের বাইরে বেরিয়ে আসে এবং আক্রান্ত স্থানে জমা হয়। এই তরল ক্ষয়ের পরিমাণ এতটাই বেশি হতে পারে যে, তা রক্তনালীতে রক্তের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়, যা হাইপোভলেমিয়া (Hypovolemia) নামে পরিচিত। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রচুর পরিমাণে ফ্লুইড (যেমন স্যালাইন) এবং প্লাজমা বা রক্তের প্রয়োজন হয়।
২. রক্তকণিকার ক্ষতি: উচ্চ তাপমাত্রার কারণে রক্তকণিকা, বিশেষ করে লোহিত রক্তকণিকা (Red Blood Cells), সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। লোহিত রক্তকণিকা অক্সিজেন পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের ক্ষতি হলে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়, যা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে তাজা রক্ত বা প্যাকড রেড ব্লাড সেল দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
৩. সংক্রমণ এবং টিস্যু নেক্রোসিস: আগুনে পোড়ার পর ত্বক তার সুরক্ষা প্রাচীর হারিয়ে ফেলে, ফলে শরীর জীবাণু দ্বারা সহজে আক্রান্ত হয়। গুরুতর সংক্রমণে শরীর দ্রুত রক্ত তৈরি করতে পারে না এবং বিদ্যমান রক্তকণিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া, পোড়া টিস্যু মরে গেলে (নেক্রোসিস) শরীর সেই মৃত টিস্যু অপসারণের জন্য রক্ত ব্যবহার করে, যা রক্তের চাহিদা আরও বাড়িয়ে তোলে।
৪. অস্ত্রোপচার ও ড্রেসিং: আগুনে পোড়া রোগীদের প্রায়শই একাধিকবার অস্ত্রোপচার করাতে হয়, যেমন - ডেব্রাইডমেন্ট (মৃত টিস্যু অপসারণ) এবং স্কিন গ্রাফটিং (ত্বক প্রতিস্থাপন)। প্রতিটি অস্ত্রোপচারেই রক্তক্ষয় হয়। তাছাড়া, নিয়মিত ড্রেসিং পরিবর্তনের সময়ও কিছুটা রক্তক্ষরণ হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে রক্তের চাহিদা বাড়ায়।
৫. রক্তাল্পতা (Anemia): দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ, পুষ্টির অভাব এবং বারবার রক্তক্ষরণের কারণে আগুনে পোড়া রোগীরা রক্তাল্পতায় ভুগতে পারে। রক্তাল্পতা মোকাবিলায় নিয়মিত রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় রক্তের ভূমিকা:
আগুনে পোড়া রোগীর স্থিতিশীলতা এবং জীবন রক্ষায় রক্তের ভূমিকা অপরিসীম। রক্ত ও তরল পদার্থের সঠিক এবং সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে শক, কিডনি ফেইলিওর এবং অন্যান্য গুরুতর জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়। চিকিৎসকরা রোগীর পোড়ার মাত্রা, শরীরের মোট পোড়া পৃষ্ঠের শতাংশ (Total Body Surface Area - TBSA), বয়স এবং অন্যান্য শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে রক্তের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করেন।
এ কারণে, আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় রক্তদান কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং রক্তদানে উৎসাহিত করা এই গুরুতর রোগীদের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আপনার মতামত লিখুন: