জুলাই ২০, ২০২৫, ০৩:৩২ পিএম
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর চীনের বিশাল বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প। ভারত ও বাংলাদেশ হয়ে প্রবাহিত এই গুরুত্বপূর্ণ নদীর উজান তিব্বতে চীন একটি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করেছে, যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গত শনিবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং উপস্থিত ছিলেন। চীনা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এই তথ্য নিশ্চিত করেছে, যা ভারতের গুরুতর উদ্বেগ সত্ত্বেও চীনের অটল অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।
আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিব্বতে ইয়ারলুং জ্যাংপো এবং ভারতে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত এই নদীর উপর বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন গত ডিসেম্বরে বেইজিং দেয়। এনডিটিভি'র রোববারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রকল্পটি চীনের কার্বন নিঃসরণ শূন্যের লক্ষ্য এবং তিব্বত অঞ্চলের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। চীনা সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, "এই বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রধানত অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহের জন্য প্রেরণ করা হবে, পাশাপাশি তিব্বতের স্থানীয় চাহিদা মেটাতেও ব্যবহৃত হবে।"
এই প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে পাঁচটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সিনহুয়া আরও জানিয়েছে, এই প্রকল্পে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১৬৭.১ বিলিয়ন ডলার) ব্যয় হবে। একবার নির্মাণ সম্পন্ন হলে, এই বাঁধটি চীনের ইয়াংসি নদীর উপর নির্মিত রেকর্ডধারী থ্রি গর্জেস ডামকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, এই বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ভারত এবং বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের ওপর সম্ভাব্য গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারত এই প্রকল্প নিয়ে চীনের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, তারা "পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজনে স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।" তখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চীনকে সতর্ক করে বলেছিল যে, "উজানে চীনের কার্যকলাপে যেন ব্রহ্মপুত্রের নিম্নপ্রবাহের দেশগুলোর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হয়।"
অন্যদিকে, গত ডিসেম্বরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল যে, এই প্রকল্পের ফলে নিম্নপ্রবাহের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না এবং চীন "নদীর নিম্নপ্রবাহের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখবে।" কিন্তু ভারতের উদ্বেগ সত্ত্বেও চীনের একতরফা পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক জলনীতিতে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বিশাল এই বাঁধ ভারত এবং বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবিকা, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ, কৃষিকাজ ও জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ কমিয়ে বা বন্যার সময় হঠাৎ পানির চাপ ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিম্নপ্রবাহের দেশগুলোর ক্ষতি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
কেবল নিম্নপ্রবাহের দেশগুলোর উদ্বেগই নয়, পরিবেশবাদীরাও তিব্বতের পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলে এ ধরনের মেগা প্রকল্পের কারণে অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পরিবেশবিদরা বলছেন, তিব্বতের পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল হিমবাহ-নির্ভর এই অঞ্চলে বড় বাঁধ নির্মাণ জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর ইকোসিস্টেম এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর অপূরণীয় প্রভাব ফেলতে পারে। হিমবাহ গলে যাওয়া, নদীর স্বাভাবিক গতি পরিবর্তন হওয়া এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের অংশ, যেখানে যেকোনো বৃহৎ অবকাঠামো পরিবর্তন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
ব্রহ্মপুত্রে চীনের এই বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প আন্তর্জাতিক জলবিরোধ এবং পরিবেশ সুরক্ষার চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। ভারতের উদ্বেগ এবং পরিবেশবিদদের আশঙ্কার পরও চীনের এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন জলসীমান্ত ইস্যুকে আরও জটিল করে তুলেছে। নিম্নপ্রবাহের দেশগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণ এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনযাত্রায় কী প্রভাব ফেলে, তা সময়ই বলে দেবে।
আপনার মতামত লিখুন: