শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫, ৩১ শ্রাবণ ১৪৩২

নির্বাচন সংস্কারের আল্টিমেটাম: ডিজিএফআই-কে নিষিদ্ধ করার দাবি

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

আগস্ট ১৪, ২০২৫, ১১:১৭ পিএম

নির্বাচন সংস্কারের আল্টিমেটাম: ডিজিএফআই-কে নিষিদ্ধ করার দাবি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরণ এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি এনসিপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয় যুবশক্তি কর্তৃক একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনে এনসিপির শীর্ষ নেতারা দেশের রাজনৈতিক সংকট, নির্বাচন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন। এই সম্মেলন থেকে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা।

সম্মেলনের শুরুতেই এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারি নির্বাচন কমিশনের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, যদি নির্বাচন সংস্কার করা না হয়, তাহলে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো নির্বাচন হবে না। তার এই বক্তব্য এক ধরনের আল্টিমেটাম হিসেবেই রাজনৈতিক মহলে বিবেচিত হচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা নেই এবং এই কমিশন দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তার এই বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক সংকটের একটি মূল দিক তুলে ধরেছে, যেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক হতাশা রয়েছে।

নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারির বক্তব্যকে সমর্থন করে এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলামও একই সুর ধরেছেন। তিনি বলেন, 'সংস্কার ও জুলাই সনদ' বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এই 'জুলাই সনদ' মূলত দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কারের জন্য একটি রূপরেখা, যা দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা দিয়েছে। নাহিদ ইসলামের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, এনসিপি শুধুমাত্র নির্বাচন নয়, বরং দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থার সংস্কারের পক্ষে। তিনি বলেন, শুধুমাত্র একটি নির্বাচন দিয়ে দেশের সমস্যার সমাধান হবে না, বরং সামগ্রিক সংস্কারের মাধ্যমেই একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি সম্ভব।

এই সম্মেলনের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দিক ছিল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে করা গুরুতর অভিযোগ। এনসিপির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ডিজিএফআই-এর কার্যক্রমের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এই এজেন্সিগুলো দেশের মিডিয়া এবং আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, ডিজিএফআই রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করছে এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য ছিল খুবই কঠোর। তিনি বলেন, ডিজিএফআই-কে হয় সংস্কার করতে হবে, নতুবা প্রয়োজনে নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত। তার এই বক্তব্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রাজনৈতিক ভূমিকার ওপর এক নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, দেশের রাজনীতিতে সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রভাব নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে।

সম্মেলনে গণমাধ্যম এবং মামলা-মোকদ্দমার বিষয়টিও উঠে আসে। এনসিপির আরেক নেতা সারজেস আলম গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বিএনপি নেতার করা মামলার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, যখনই কেউ সত্যি কথা বলে বা সরকারের সমালোচনা করে, তখনই তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। তার মতে, এটি একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার লক্ষণ, যেখানে ভিন্নমত প্রকাশ করার স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, গণতন্ত্রে ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার একটি মৌলিক বিষয়, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই অধিকার প্রায় নেই বললেই চলে। তার এই বক্তব্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের কৌশলকে তুলে ধরেছে।

এই সম্মেলনে শুধুমাত্র এনসিপির নেতারাই উপস্থিত ছিলেন না, বরং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও এতে অংশগ্রহণ করেন, যা সম্মেলনের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এনি এবং জামাত নেতা সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, এনসিপি একটি জোটবদ্ধ আন্দোলনের চেষ্টা করছে, যেখানে বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হয়ে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আসতে পারে। তাদের এই অংশগ্রহণ এনসিপির রাজনৈতিক প্রভাব এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছে।

সম্মেলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল জাতীয় যুবশক্তির পক্ষ থেকে সাত দফা যুব ইশতেহার ঘোষণা করা। এই ইশতেহারে দেশের যুবসমাজের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যুব ইশতেহারের মাধ্যমে জাতীয় যুবশক্তি দেশের তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে যে, দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যুবসমাজের হাতে এবং তাদের জন্য একটি সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা অপরিহার্য।

এই সম্মেলন থেকে স্পষ্ট যে, এনসিপি দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে চায় এবং এর জন্য তারা নির্বাচন সংস্কার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার এবং একটি জোটবদ্ধ আন্দোলনের উপর জোর দিচ্ছে। এই সম্মেলন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে এবং আগামী দিনের রাজনীতিতে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে।