মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২

জীবনে বরকত আসে যেসব আমলে

দিনাজপুর টিভি ডেস্ক

আগস্ট ১০, ২০২৫, ১১:৩৬ এএম

জীবনে বরকত আসে যেসব আমলে

ছবি- সংগৃহীত

বরকত এমন এক কল্যাণ যা কমকেও বাড়িয়ে দেয় এবং অল্পতেও তৃপ্তি এনে দেয়। ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, হায়াত, কিংবা ইবাদত—সবকিছুতেই বরকত লাভ বান্দার জন্য মহান আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। অনেকেই কঠোর পরিশ্রম করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পান না, আবার কেউ অল্প পরিশ্রমেও অভাবনীয় সাফল্য পান। এর কারণ হলো বরকত। জীবনে এই বরকত লাভের জন্য কুরআন ও সুন্নাহে অনেক নির্দেশনা রয়েছে।

 

১. বেশি বেশি ইসতেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করা

জীবনে বরকত লাভের অন্যতম প্রধান আমল হলো আল্লাহর কাছে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করা। এর কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা বা সময় নেই, বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চাওয়া। কমপক্ষে 'আসতাগফিরুল্লাহ' বলা যেতে পারে। ক্ষমা চাওয়ার সময় মনে গভীর অনুশোচনা রাখা এবং অন্তর দিয়ে অনুভব করা যে, সকল অন্যায় ও অপরাধ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া হচ্ছে।

কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা: আল্লাহ তায়ালা সূরা নূহে নূহ (আ.)-এর ইসতেগফারের বর্ণনা তুলে ধরেছেন, যেখানে ইসতেগফারের মাধ্যমে অজস্র বরকত লাভ হয়: "অতপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।" (সূরা নূহ: আয়াত ১০-১২)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি ইসতেগফার ধরে রাখবে, সব কঠিন অবস্থায় আল্লাহ তাআলা (তার জন্য) বের হওয়ার পথ দেখিয়ে দেবেন। সব পেরেশানি থেকে আল্লাহ তাআলা তার জন্য প্রশস্ততার পথ বের করে দেবেন।"

সুতরাং, নিয়মিত এবং আন্তরিকভাবে ইসতেগফার করার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও বরকত লাভ করার চেষ্টা করা উচিত।

 

২. আল্লাহর ওপর ভরসা করা

 

জীবনে বরকত লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চাবি হলো আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ভরসা রাখা। একজন মুমিন আল্লাহর ওপর যত বেশি ভরসা করবে, আল্লাহ তাকে তত বেশি সাহায্য করবেন। পক্ষান্তরে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বা নির্ভরতা যত কমবে, মানুষ তত বেশি অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে। বিপদের সময় আল্লাহর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলা বা নেতিবাচক মন্তব্য করা কোনোভাবেই উচিত নয়।

হাদিসের নির্দেশনা: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "আল্লাহর প্রতি যেরকম ভরসা বা আস্থা রাখা দরকার, তোমরা যদি সেই মাপের আস্থা রাখতে পার, তাহলে আল্লাহ তাআলা পাখিকে যেভাবে রিজিক দেন, তোমাদেরও সেভাবে রিজিক দেবেন।"

কাজেই, জীবনের সব ক্ষেত্রে কাজের পাশাপাশি শুধুমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা করা জরুরি। যার ভরসা যত বেশি হবে, তার বরকত লাভের সম্ভাবনাও তত বেশি হবে।

৩. নামাজ প্রতিষ্ঠা করা

 

নিজেরা যেমন প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজ নিয়মিত পড়তে হবে, তেমনি পরিবারের সদস্যদেরও নামাজ পড়ার নির্দেশ দিতে হবে এবং তাদের ব্যাপারে খোঁজ রাখতে হবে। কেননা, নামাজ মানুষকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং আল্লাহর রহমত টেনে আনে।

কুরআনের নির্দেশনা: আল্লাহ তাআলা বলেন, "আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে নামাজের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন। আমি আপনার কাছে কোনো রিজিক চাই না। আমি আপনাকে রিজিক দেই এবং আল্লাহকে ভয় করার পরিণাম শুভ তথা কল্যাণকার।" (সূরা ত্বাহা: আয়াত ১৩২)

 

৪. সকালবেলা কাজ শুরু করা

 

দিনের শুরুতেই কাজ শুরু করা বরকত লাভের অন্যতম উপায়। যদি কারো অফিস, আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য একটু দেরিতেও শুরু হয়, তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু নিজের ঘরের কাজ দিয়েই হোক না কেন, সকাল সকাল কাজ শুরু করা উচিত। সকালের সময়েই আল্লাহ তাআলা বরকত দান করেন।

হাদিসের নির্দেশনা: রাসূলুল্লাহ (সা.) দোয়া করেছেন, "হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতকে সকালবেলা বরকত দান করবেন।" অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন, "আমার উম্মতের জন্য সকালবেলার সময়টাতে বরকত দেওয়া হয়েছে।"

সুতরাং, যারা সকালের সময়টিতে ঘুমিয়ে থাকে, তারা এই বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। দিনের শুরুতে মহান আল্লাহর নাম নিয়ে কাজ শুরু করার মাধ্যমে বরকত ও কল্যাণ লাভ করা জরুরি।

 

৫. বেশি বেশি দান করা

 

দান-সাদকায় বরকত নেমে আসে। অনেক হাদিসে এটি প্রমাণিত যে, দানের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বিপদ-মুসিবত দূর করে দেন। বিপদ-আপদ থাকলে কোনো কাজে বরকত লাভের সুযোগ থাকে না। তাই সব কাজে বরকত লাভের জন্য বেশি বেশি দান করা উচিত।

হাদিসের নির্দেশনা: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "দান করার কিছু যদি না থাকে, তবে একটি খেজুরের অংশ দিয়ে হলেও দান করার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা কর।"

দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভের জন্য পরিমাণে কম হলেও প্রতিদিন সাধ্যানুযায়ী দান করা উচিত। কাউকে সরাসরি দান করতে না পারলে একটি নির্দিষ্ট অংশ নিজ ঘরে একটি বাক্সে জমা করে পরে তা দান করা যেতে পারে। এই পদ্ধতির মাধ্যমেই প্রতিদিন সাদকাহর সাওয়াব পাওয়া যাবে এবং বরকত নেমে আসবে।

 

৬. আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা

 

আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে জীবনে বরকত ও কল্যাণ নেমে আসে। এটি একটি পরীক্ষিত আমল। মা-বাবা, ভাই-বোন এবং রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। যদি আত্মীয়দের কেউ খারাপ আচরণও করে, তবুও নিজের পক্ষ থেকে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। প্রয়োজনে সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য করা, সাহায্য করতে না পারলে তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা। এর মাধ্যমে জীবনে বরকত ও কল্যাণ নেমে আসে।

 

৭. যে কোনো কাজের শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' বলা

 

যেকোনো কাজের শুরুতে 'বিসমিল্লাহ' বলা বরকত লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। যখন কোনো কাজ 'বিসমিল্লাহ' বলে শুরু করা হয়, তখন শয়তানের প্রভাব কমে যায় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ আসে।

হাদিসের নির্দেশনা: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে কেউ যখন খাবার খায় আর যদি বিসমিল্লাহ বলে; তবে শয়তান ওই খাবারে অংশ নিতে পারে না। যেটুকু খাবার আছে তা (পরিমাণে কম হলেও) তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। অনুরূপভাবে কেউ যদি ঘরে প্রবেশ করার সময় বিসমিল্লাহ বলে, তখনও শয়তান তার সঙ্গে বাসায় ঢুকতে পারে না।"

এভাবে বান্দা যখন সব কাজ 'বিসমিল্লাহ' বলে শুরু করে, তখন শয়তান সব কাজ থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহ তাআলা সব কাজেই বরকত দান করেন।

 

৮. কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো

কুরআনের সাথে সম্পর্ক বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। কুরআন তেলাওয়াত করা, এর অর্থ অধ্যয়ন করা এবং কুরআন অনুযায়ী জীবন গড়া। যে যত বেশি কুরআনের সাথে সম্পর্ক বাড়াবে, তার জন্য তত বেশি বরকত নেমে আসবে। যে ঘরে কুরআন তেলাওয়াত হবে, কুরআনের চর্চা হবে, কুরআনের ওপর আমল করা হবে, সে ঘরেই নেমে আসবে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত ও কল্যাণ।

কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা: আল্লাহ তাআলা একাধিক আয়াতে বলেন, "এটি এমন একটি কিতাব, যা আমি অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়, অতএব, এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর; যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও।" (সূরা আন'আম: আয়াত ১৫৫)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "আল্লাহ তাআলা এ কিতাব (কুরআন) দিয়ে বহু মানুষকে (বরকতের মাধ্যমে) ওপরে ওঠাবেন। আবার বহু মানুষকে নিচে নামাবেন।" (মুসলিম) অর্থাৎ, যারা কুরআনুল কারিমের অনুসরণ করবে, তাদের জন্য এ কিতাব হবে বরকতের কারণ। আর যারা এ থেকে দূরে সরে যাবে, তা হবে তাদের জন্য অমঙ্গলজনক হওয়ার কারণ।