জুলাই ২০, ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পাট এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা 'সোনালি আঁশ' নামেই পরিচিত। বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত এবং জলাশয়ে পানি থাকা পাট জাগ দেওয়ার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা এখন কৃষি খাতকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। আষাঢ় মাস পেরিয়ে শ্রাবণ চললেও দিনাজপুরে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির দেখা না মেলায় পাটচাষিরা এক গভীর সংকটে পড়েছেন। পানির অভাবে পাট জাগ দিতে না পেরে তাঁদের কষ্টের ফসল এখন গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আষাঢ় মাস শেষ হয়ে এখন শ্রাবণ চললেও দিনাজপুরে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির দেখা মেলেনি। খাল-বিল, ডোবা অথবা বাড়ির পাশে নিচু জমি—কোথাও পর্যাপ্ত পানি নেই। ফলে পাট জাগ দিতে না পেরে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দিনাজপুরের পাটচাষিরা। এতে কষ্টের ফসল 'সোনালি আঁশ' এখন কৃষকের গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে।
আবহমানকাল ধরে বর্ষা মৌসুমে কৃষক জমি থেকে পাট কেটে এসব প্রাকৃতিক জলাশয়েই জাগ দিয়ে আসছেন। কিন্তু এ বছর বর্ষা মৌসুমের প্রধান মাস আষাঢ় পার হয়ে শ্রাবণ শুরু হলেও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না কৃষক। জেলা আবহাওয়া অফিস থেকেও নেই কোনো সুখবর।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলার ১৩ উপজেলায় মোট ৪ হাজার ৩৭২ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে নয় হাজার টন। এরই মধ্যে ৬০ ভাগ জমির পাট কাটা হয়েছে। অনেক স্থানে কৃষক জমি থেকে পাট কাটছেন, আবার অনেকে বৃষ্টি হবে এ আশায় প্রহর গুণছেন।
দিনাজপুর সদর উপজেলার উলিপুর, মহব্বতপুর, খাড়িপাড়া ও ঘুঘুডাঙ্গাসহ জেলার পুনর্ভবা নদীতীরবর্তী এলাকায় বেশি পাট চাষ হয়। গত বুধবার (১৬ জুলাই, ২০২৫) এসব এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ কৃষক খেতের পাট কাটেননি। ফলে জমিতেই পাটগাছ বিবর্ণ হয়ে হলদে রঙ ধারণ করছে।
মহব্বতপুর গ্রামের কৃষক মাহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, "বৃষ্টির অভাবে জমি শুকিয়ে গেছে। কৃষক আমন ধানের চারা রোপণ করতে পারছেন না। আর সেখানে পাট কাটবে কী করে? জমি থেকে পাট কাটলে তো খালে-বিলে বা নিচু জমিতে পাট জাগ দিতে হবে। কিন্তু কোথাও পানি নেই। তাই এলাকার কৃষক পাট কাটতে পারছেন না।"
ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামের কৃষক শহিদুল্লাহ্ জানান, বর্ষা মৌসুমে জমি থেকে পাট কেটে কৃষক সাধারণত সরকারি রাস্তার দুই ধারে খালে পাট পচান। কিন্তু এ বছর আষাঢ় মাস চলে গেলেও বৃষ্টি হচ্ছে না। যেসব কৃষকের নিজের শ্যালো পাম্প মেশিন আছে, তারা সেচ দিয়ে পাট পচানোর ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু শ্যালোর পানি পর্যাপ্ত না হওয়ায় দুদিনেই খালের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর, সাতনালা, তেঁতুলিয়া, আলোকডিহি, দেবীগঞ্জ, ডাঙ্গারহাট, ঘণ্টাঘর, বিন্যাকুড়ি, সুখীপীর, বেলতলী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানি না থাকায় কৃষক চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। নদী, পুকুর, খাল-বিল কোথাও পর্যাপ্ত পানি না থাকায় কৃষক পাট জাগ দিতে পারছেন না। অনেক কৃষককে পাট কেটে খেতেই ফেলে রাখতে দেখা গেছে। অনেকে বৃষ্টির আশায় পাট না কেটে জমিতেই রেখে দিয়েছেন। আবার অনেকেই নিচু এলাকায় জমে থাকা কাদা পানিতেই পাট জাগ দিচ্ছেন। পর্যাপ্ত পানিতে পাট জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে পরিষ্কার করতে না পারলে বিক্রির সময় কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষক।
উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের কৃষক জামিল হোসেন বলেন, "পুরো আষাঢ় মাস প্রায় বৃষ্টিহীন গেছে। শ্রাবণ শুরু হলেও তেমন বৃষ্টি নেই। এলাকার কোনো জমিতে পানি নেই। যেসব খালে সামান্য বৃষ্টির পানি জমেছে সেখানেই অনেকেই পাট জাগ দিচ্ছেন। অনেকেই বাধ্য হয়ে শ্যালো মেশিন ও মোটর বসিয়ে পুকুর, ডোবা-নালায় পানি তুলে বা ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে।"
খানাসামা উপজেলার আলোকডিহি ইউনিয়নের কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন, "এ বছর আমি তিন বিঘা জমিতে পাটচাষ করেছি। এর মধ্যে এক বিঘা জমির পাট কেটে রেখে দিয়েছি। পানির অভাবে জাগ দিতে পারছি না। অবশিষ্ট দুই বিঘা জমির পাট এখনো জমিতে দাঁড়িয়ে আছে।"
খানসামা উপজেলার পাকেরহাট এলাকার সোলায়মান আলী, রমানাথ সাহা সহ অনেক কৃষক বলেন, গত কয়েক বছরের চেয়ে এ বছর পাটের আবাদ ভালো হয়েছে। পাট কেটে জমিতে স্তূপ করে রেখে দিয়েছি। অনেকে আবার শুকনো জমিতে পাটি বিছিয়ে জাগ দেওয়ার মতো করে রেখেছে বৃষ্টির পানির আশায়। খাল, বিল, পুকুর-ডোবা-নালা আর নিচু জমিতে কোথাও পর্যাপ্ত পানি নেই। তাই পাট জাগ দিতে পারছি না। পাটের স্তূপ প্রখর রোদে শুকিয়ে যাচ্ছে।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. আনিছুজ্জামান বলেন, "এখনও শ্রাবণ মাস আছে, আশা করা যায় বৃষ্টি হলে এই সংকট কেটে যাবে। অনেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানির ব্যবস্থা করে জাগ দিয়েছেন। তবে কৃষক বসে নেই। নিজেদের উদ্যোগে সেচের ব্যবস্থা করে বেশির ভাগ কৃষক পাট জাগ দিচ্ছেন।"
আপনার মতামত লিখুন: