জুলাই ১৮, ২০২৫, ১০:৫৯ এএম
বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার হার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হলে মানুষের আয়-রোজগার বৃদ্ধি এবং বেকারত্ব দূর করা অপরিহার্য। এই প্রেক্ষিতে, ড. ফোরকান আলী এক যুগান্তকারী প্রস্তাব দিয়েছেন যে, শুধু পশুসম্পদ খাতেই আগামী ছয় মাসে এক কোটি লোকের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। তার মতে, এই খাতকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখা যাবে।
বিবিএস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ ৮৯ হাজারটি এবং কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি ২ কোটি ২৯ লাখ ৩১ হাজার জন। এদের মধ্যে অনেকেই মৌসুমি বেকারত্ব বা আংশিক বেকারত্বের শিকার, অর্থাৎ কখনো কাজ থাকে আবার কখনো থাকে না।
ড. ফোরকান আলীর প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ হাজার ৪৮৮টি ইউনিয়ন এবং ৮৭ হাজার ৬২৩টি ছোট-বড় গ্রাম রয়েছে। প্রতিটি গ্রাম থেকে যদি গড়ে ১২০ জন সুফলভোগী নির্বাচন করা হয়, তাহলে ৮৭ হাজার ৬২৩টি গ্রাম থেকে মোট ১ কোটি ৫ লাখ ১৪ হাজার ৭৬০ জন সুফলভোগী নির্বাচন করা সম্ভব। এই সুফলভোগীদের মধ্যে বেকার যুবক বা যুব মহিলা, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত, শিক্ষিত বেকার যুবক ও উৎসাহী কৃষক অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।
তিনি বলেন, এই নির্বাচিত ১২০ জন সুফলভোগীর মধ্যে ৩০ জনকে ‘দুধেল গাভি পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ’, ৩০ জনকে ‘গরু মোটাতাজাকরণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ’, ৩০ জনকে ‘ছাগল পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ’ এবং ৩০ জনকে ‘জৈব-নিরাপত্তা সম্পন্ন হাঁস-মুরগির খামার বিষয়ক প্রশিক্ষণ’ দিয়ে তাদের জন্য স্বল্প সুদে বা বিনা সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এই ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও তদারকির জন্য একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ দেবে এবং তা আদায়েও তারাই কাজ করবে। অন্যদিকে, স্থানীয় পশুসম্পদ অফিস এই কার্যক্রম তদারকি করবে। এ জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ন্যায় স্থানীয় উপজেলা পশুসম্পদ অফিসের মাধ্যমে ‘পশুসম্পদ সম্প্রসারণ কার্যক্রম’ হাতে নিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট উপজেলার অধীনস্থ প্রতিটি গ্রাম থেকে উদ্যমী, পরিশ্রমী ও নিরলস সুফলভোগীকে নির্বাচন করতে হবে। তাদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও কারিগরী জ্ঞান দিতে হবে। হাতেকলমে সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদান, নিয়মিত খামার পরিদর্শন এবং সমস্যা দেখা মাত্রই সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন প্রদান, জৈব নিরাপত্তাসহ স্বাস্থ্যসম্পন্ন খামার স্থাপনের বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। খামারিদের পশুপুষ্টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে যাতে তারা পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার নিশ্চিত করতে পারে। খামার ব্যবস্থাপনা, হাউজিং, লাইটিং, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কে খামার ব্যবস্থাপকের সঠিক ধারণা থাকলে সব খামারই লাভজনক খামারে পরিণত হবে। সরকারকে উদ্যোক্তাদের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বিশেষ ঋণ হিসেবে ‘সুদবিহীন ঋণ’ বা ‘স্বল্প সুদে ঋণের’ ব্যবস্থা করে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
পশুসম্পদ খাতের সম্ভাবনা:
ড. ফোরকান আলী আরও উল্লেখ করেন যে, ফসল উৎপাদনের জন্য এ দেশের ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকের জমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়, কারণ জমির পরিমাণ সীমিত। সব কৃষকের পুকুর তৈরির জমিও নেই। কিন্তু যাদের অন্তত বসতভিটা আছে, তাদের পক্ষে একটি গাভি, দুটি ছাগল, কয়েকটি হাঁস-মুরগি পালন করা সম্ভব। তাই পশুসম্পদ খাতেই এ দেশের কৃষকদের কর্মসংস্থান ও আয়-রোজগার বৃদ্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে।
পশুসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে দুধের চাহিদা ছিল ১৩.০১ মিলিয়ন মেট্রিক টন হলেও উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ২.৬৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন, ঘাটতি ছিল ১০.৩৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। জনপ্রতি দুধের চাহিদা প্রতিদিন ২৫০ মিলিলিটার হলেও প্রাপ্যতা ছিল মাত্র ৫১ মিলিলিটার। মাংসের ক্ষেত্রেও ঘাটতি বিপুল; বার্ষিক চাহিদা ৬.২৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন হলেও উৎপাদন ছিল মাত্র ১.০৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ডিমের চাহিদাও ব্যাপক, বার্ষিক চাহিদা ১৪ হাজার ৮২৮ মিলিয়ন হলেও উৎপাদন ছিল মাত্র ৫ হাজার ৬৫৪ মিলিয়ন। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, পশুসম্পদ সম্প্রসারণ কার্যক্রম শুরু করা কতটা জরুরি।
বর্তমানে বাংলাদেশে পশুসম্পদ একটি বিপুল সম্ভাবনাময় খাত হলেও, বছরে জাতীয় অর্থনীতিতে পশুসম্পদের প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২.৪১ শতাংশ এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এর অবদান ছিল মাত্র ২.৭৯ শতাংশ। এই হার অনেক বেশি বৃদ্ধি করা সম্ভব। শুধু চামড়া থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে বছরে ৪.৩১ শতাংশ, যা আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। গরুর গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। গত অর্থবছরে গরুর গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা থেকে জৈব সার উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৮০ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা অনেক বেশি বাড়ানো যায়।
ড. ফোরকান আলীর মতে, এ দেশের মানুষের আছে উদ্যম, উচ্ছ্বাস, স্বপ্ন, অভিলাষ এবং রক্ত দিয়ে বিজয় অর্জনের ইতিহাস। সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা, উদ্বুদ্ধকরণ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ করে বিপুল সম্ভাবনাময় পশুসম্পদ খাতকে কাজে লাগিয়ে এ দেশে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। এতে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংগ্রামে আমরাই অবদান রাখতে সক্ষম হব।
আপনার মতামত লিখুন: