জুলাই ৩০, ২০২৫, ১১:৩১ এএম
মোকছুদ আহমদ প্রায় এক কানি জায়গায় বিভিন্ন ফসল ও ফলের চাষ করছেন। আম, কাঁঠাল, জাম, পেয়ারাসহ নানা জাতের ফলের গাছ রয়েছে তাঁর জমিতে। এখন এসব গাছের ফাঁকে ফাঁকে ভিন্ন পদ্ধতিতে বস্তায় আদা চাষ শুরু করেছেন। এতে তাঁর বাড়তি আয় হচ্ছে।
পেশায় কৃষক মোকছুদ আহমদের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বারইয়ারহাট পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। একসময় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে ছিলেন তিনি। এরপর দেশে এসে কৃষিকাজে মন দেন। প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই মোকছুদ আহমদ বলেন, ‘স্থানীয় এক কৃষি উদ্যোক্তার পরামর্শে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো বস্তায় আদা চাষ শুরু করি। শুরুতে দুই হাজার বস্তা ছিল। বর্তমানে সেটি সাত হাজার বস্তায় দাঁড়িয়েছে। গত বছর আয় হয় প্রায় চার লাখ টাকা। এ বছর আয় আট লাখ টাকা ছাড়াবে।’
শুধু মোকছুদ আহমদ নন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাঁর মতো আরও ২৪ হাজার কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তা বস্তায় আদার চাষ করছেন। বছর তিনেক আগে চট্টগ্রামে এ পদ্ধতিতে আদা চাষ শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে মানুষ তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তবে পড়ে থাকা জমিতে কম পরিশ্রমে এ পদ্ধতিতে আদার চাষ করতে পারায় মানুষ এখন আগ্রহী হচ্ছেন। শুরুতে হাজারখানেক লোক চাষ শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে চাষির সংখ্যা ও উৎপাদন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে বাড়তি উৎপাদনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। যেমন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১ হাজার বস্তায় ১২ হাজার কেজি আদার চাষ হয়। পরের অর্থবছরে ২২ হাজার ১৬৭ বস্তায় চাষ হয় ১৫ হাজার কেজি, অর্থাৎ ৩ হাজার কেজি বেড়েছে। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে চট্টগ্রামে ২৪ হাজার বস্তায় চাষ হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কেজি। ১৭ হাজার কেজি আদার বাজারমূল্য আনুমানিক ২৫ লাখ টাকা।
যে পদ্ধতিতে চাষ
কৃষি কর্মকর্তা ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ পদ্ধতিতে প্রথমে বস্তায় পরিমাণমতো জৈব ও রাসায়নিক সার এবং বেলে দোআঁশ মাটি দিতে হয়। এর সঙ্গে দানাদার কীটনাশক মিশিয়ে দিতে হয়। একেকটি বস্তায় ২০ থেকে ২৫ কেজি মাটি দিতে হয়। পরে তাতে বীজ আদা রোপণ করতে হয়। একেকটি বস্তায় তিনটি চারা রোপণ করা হয়। প্রতি বস্তায় খরচ হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। প্রতি বস্তায় গড়ে এক কেজির মতো আদা পাওয়া যায়। প্রতি কেজি আদা ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়।
মিরসরাইয়ের আরেক বাসিন্দা যিশু চৌধুরী তাঁর পুকুরপাড়ের পরিত্যক্ত জমিতে আদার চাষ শুরু করেন। গত বছর মাত্র ৫০টি বস্তায় আদার চারা রোপণ করেন। এ বছর তা ৫০০ ছাড়িয়েছে। যিশু চৌধুরী বলেন, "এ পদ্ধতিতে আদার চাষ করলে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। শুরুতে বস্তাগুলো প্রস্তুত করে দিলে পরবর্তী সময়ে আর পরিচর্যার তেমন প্রয়োজন পড়ে না।"
চাহিদা ও আমদানি পরিস্থিতি
গত বছর পরিমাণের হিসাবে সবচেয়ে বেশি আদা আমদানি করেছে বাংলাদেশ। পেছনে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোকে। এ সময়ে ১ লাখ ৫২ হাজার টন আদা আমদানি হয়েছে, যার বাজারমূল্য ছিল ৩ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। দেশি উৎপাদনের বাজারমূল্য যোগ করা হলে তা চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
শুধু আমদানি বাড়ছে বিষয়টি এমন নয়, দেশে চাহিদাও বাড়ছে। এক দশক আগে প্রতিটি পরিবারে বছরে আদার চাহিদা ছিল সাড়ে তিন কেজির কিছু বেশি। এখন প্রতিটি পরিবারে আদার ব্যবহার বেড়ে হয়েছে পৌনে ছয় কেজি।
আগ্রহ বাড়ছে
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসিন্দা মুহাম্মদ ইউসুফ ২০ কানি জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষ করছেন। এবার প্রথমবারের মতো তিনি শুরু করেছেন বস্তায় আদা চাষ। দুই মাস আগে ৫০০টি বস্তায় বীজ রোপণ করেছেন। মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, "বস্তা পদ্ধতিতে চাষ করলে আগাছা বেশি হয় না। এ ফসল চাষে অতিরিক্ত জায়গারও প্রয়োজন হয় না।" তিনি বাগানে ফল গাছের ফাঁকে ফাঁকে বস্তা বসিয়েছেন। ৮–৯ মাসের মধ্যে ফলন পাবেন।
আরেক আদা চাষি আবু আহমদও প্রথমবারের মতো আদা চাষ শুরু করেছেন। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলে উৎপাদন ভালো হয়। গাছে পোকামাকড়ও ধরে না। আগামী ফেব্রুয়ারির দিকে তিনি ফলন তুলতে পারবেন। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে দুই–তিন লাখ টাকা লাভ করার আশা করছেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. ওমর ফারুক বলেন, "বেশ কয়েকটি কারণে বস্তায় আদা চাষে আগ্রহ বাড়ছে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচ কম। ঘরের আশপাশের জমিতে কিংবা জমির আলে চাষ করা যায়। ফলে বাড়তি জমির প্রয়োজন হয় না। বাজারমূল্যও ভালো। ফলে আগামী বছরগুলোতে উৎপাদন আরও বাড়বে।"
আপনার মতামত লিখুন: